বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


এম মামুন হোসেন | Published: 2023-08-15 15:57:03 BdST | Updated: 2024-04-27 13:18:51 BdST
সারাটা জীবন শুধু সাধারণ মানুষের কল্যাণ চেয়ে নিজের সব চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আত্মপ্রকাশ ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। এই দিকটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব কম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই সেই সময়ের টগবগে তরুণ শেখ মুজিবকে বাঙালির মুক্তির ভবিষ্যৎ নেতা বানিয়েছে। যেসব বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
 
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিএ ডিগ্রি নিয়ে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় চলে আসেন। পিতা লুৎফর রহমানের ইচ্ছা ছিল পুত্র শেখ মুজিব আইনজীবী হোক। পিতার ইচ্ছা পূরণে তিনি ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। সে সময় আইন বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক এমইউ সিদ্দিক। ভর্তির সময় তিনি তাঁকে নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর রোল নম্বর ছিল ১৬৬। আইনের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন এসএম হলের সংযুক্ত ছাত্র হলেও তিনি থাকতেন পুরান ঢাকার মোগলটুলিতে। একটি সাইকেলে চড়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। আড্ডা দিতেন ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে। সেখানেই তিনি সমকালীন রাজনীতি নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের দুর্দশা দেখে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। এ সময় তাঁর মধ্যে অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্যায়ের প্রতি তিনি হয়ে ওঠেন আপসহীন সংগ্রামী। 
 
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ভীষণভাবে তাদের পক্ষে অবস্থান নেন। তখন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হতো না। মুখের কথায় চাকরি হতো। আবার মুখের কথায় চাকরি চলে যেত। তাদের দৈনন্দিন কাজের কোনো সময়সূচি ছিল না। তাদের কোনো বাসস্থান ছিল না। যখন তখন কাজের জন্য ডাকা হতো। যেকোনো কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হতো। তাদের সঙ্গে কৃতদাসের মতো ব্যবহার করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্ররা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। 
 
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে এবং আরও চারজনকে ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তিনি আইন বিভাগের দ্বিতীয় এরপর পৃষ্ঠা ২ কলাম ৩
 
বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 
বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, ১৫ রুপি জরিমানা এবং পরিবারের মাধ্যমে মুচলেকা দিয়ে তারা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে। শেখ মুজিব ছাড়া অন্য চারজন ছিলেন কল্যাণ চন্দ্র দাশগুপ্ত, নাঈমউদ্দিন আহমেদ, নাদেরা বেগম এবং আবদুল ওয়াদুদ। তারা সবাই জরিমানা এবং মুচলেকা দিলেও বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে রাজি হননি। এরপর বঙ্গবন্ধুর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। 
 
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে ২৭ এপ্রিল দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হয়। পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। জেলে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসব। তবে ছাত্রনেতা হিসেবে নয়, একজন দেশকর্মী হিসেবে।’ মাত্র আড়াই বছর পর বঙ্গবন্ধু আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক কর্মী সমাবেশে আসেন। তবে এবার আসেন একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে, বঞ্চিত ও শোষিত বাঙালির আলোর দিশা হয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন, তখন ২৩ জুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে ওই দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। জেলে আটক থাকার সময় একটি বড় দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া ছিল তাঁর প্রতি বিশাল আস্থা। এরপর ধীরে ধীরে নিজ যোগ্যতায় জাতীয় নেতায় পরিণত হন তিনি। ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। অথচ বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। 
 
দীর্ঘ ৬১ বছর পর ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মনীতি মানেনি বলেই নথিপত্র দেখে সিন্ডিকেট সদস্যদের মনে হয়েছে। এ ধরনের বহিষ্কারাদেশ দেওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের লক্ষ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ছাত্রত্ব বাতিলের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো আবেদন করেননি, এমনকি তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও। ৬১ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তের কোনো ব্যবহারিক মূল্য হয়তো নেই। একটি ভুল সংশোধন করার মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা অনেক আগেই প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।
 
পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে তিনি ১৮ বার জেলে গেছেন। মোট সাড়ে ১১ বছর জেলে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন অন্তত দুই বার। কিন্তু অসম্ভব বিনয় ছিল কথাবর্তায়, চালচলনে। অপরাপর নেতাদের কখনো অসম্মান করেননি। 
 
কথাসাহিত্যিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভাষায়, ‘এত বড় যোদ্ধা একজন মানুষ, কিন্তু কী বিনয় ছিল কথাবার্তায়, চালচলনে! আইয়ুব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার নামের শেষে ‘সাহেব’ জুড়ে দিতেন। বলতেন, ইয়াহিয়া সাহেব, এত অহংকারী হবেন না। এ সাহেব ডাকে কিছুটা কৌতুক ছিল, ঠাট্টা ছিল, কিন্তু সৌজন্যও ছিল। তাঁর ভাষা ছিল শাণিত, ইস্পাতের ফলার মতো। কিন্তু মার্জিত। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, একটা সৌজন্যবোধ তিনি তাকে দেখাতেন।’