লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ আলোর বাতিঘর সকলের প্রিয় আঙিনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মতিহারের সবুজ চত্বরে নানা গৌরবোজ্জ্বল অতীত নিয়ে এই বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭২ বছরে পদার্পণ করেছে আজ। দীর্ঘ ৭১ বছরের পথ চলায় নিজস্ব আলোয় আলোকিত এ বিদ্যাপীঠ।
রাজশাহীর প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখ্শ এবং রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরি যৌথ নেতৃত্বে চেষ্টায় অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ড. ইতরাত্ হুসেন জুবেরিকে উপাচার্য নিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে এই বিদ্যাপীঠ। আজ ৭২ বছরে পা রাখলো ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানের স্থানে ছিল না। দুইটি অনুষদের (কলা ও আইন) ছয়টি বিভাগ (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইন, দর্শন ও অর্থনীতি) নিয়ে শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯৫৩-৫৪ সেশনে রাজশাহী কলেজে ১৫৬ জন ছাত্র, ৫ জন ছাত্রী ও ২০ জন শিক্ষক নিয়ে শুরু হয় পোস্ট-গ্রাজুয়েট কোর্সের পাঠদান। প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয় ১৯৬২ সালে।
রাজশাহী কলেজের কাছে পদ্মাপারে অবস্থিত ডাচদের তৈরি বড়কুঠিতে উপাচার্যের প্রথম অফিস বসানো হয়। ছাত্রদের থাকার জন্য শহরের বিভিন্ন ভবন ভাড়া করা হয়। রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন ফুলার হোস্টেলকে করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস৷ বড়কুঠি এলাকার লালকুঠি ভবন ও আরেকটি ভাড়া করা ভবনে স্থাপন করা হয় ছাত্রী নিবাস।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ১৯৫৮ সালে শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মতিহার ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণের কাজ। ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম বর্তমান ক্যম্পাসে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫টি হল নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ছাত্রদের ৪টি (শেরে বাংলা ফজলুল হক হল, শাহ্ মখদুম হল, নবাব আব্দুল লতিফ হল ও সৈয়দ আমীর আলী হল) ও ছাত্রীদের ১টি (মন্নুজান হল)।
সেই ৭১ ধরে, বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জ্ঞান অন্বেষণে শিক্ষার্থীরা মতিহারে ছুটে এসেছেন। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জ্ঞান অন্বেষণ করে তাঁরা তাঁদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করেছেন। তাঁরা তাঁদের কর্ম-প্রতিভা-প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজ-সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। দেশ-উন্নয়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা 'মতিহারের দূত' হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়। স্বনামখ্যাত প্রথিতযশা বহু পণ্ডিত শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন, যাঁদের জ্ঞান-গরিমা পাণ্ডিত্য-স্পর্শে সিক্ত হতো শিক্ষার্থীরা। এই গুণী-শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানের আধারে পরিণত করেছিলেন। পঠন-পাঠন, গবেষণা এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানসৃষ্টি ও বিতরণে এখনও অনেক শিক্ষক নিবেদিত আছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্মপ্রভায় জড়িত থেকে এক রক্তস্নাত ইতিহাস গড়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শহীদ শামসুজ্জোহা, যিনি রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাক-হানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড. জোহার রক্তদান বিদ্যুৎ-গতিতে সকল বাংলার প্রান্তে প্রান্তে রণাঙ্গনে পৌঁছে যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে। তরান্বিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। শহীদ শিক্ষক ড. হবিবুর রহমান, শহীদ শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুমসহ বহু শিক্ষার্থী-কর্মচারীর রক্তে রক্তস্নাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শিক্ষা, গবেষণার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং সংস্কৃতির বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি দায়িত্ব পালন করে আসছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর সুখ্যাতি রয়েছে বিভিন্নভাবে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আলোকে বিশ্বের উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়ন যেমন চলছে, ঠিক তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক শিক্ষার্থী এ বিশ্বদ্যিালয়ে অধ্যয়ন করছেন। অনেক আন্তর্জাতিক মানের গবেষক রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। গবেষণার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে বহুবার। ২০১৯ সালে বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তিতে ‘সিমাগো স্কপাসের’ জরিপে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমস্থান দখল করেছিল। এভাবে বহু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার সক্ষমতা প্রকাশ করে চলছে। বাংলাদেশ তথা উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করার পিছনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু গৌরব-দীপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনন্যসেরা 'বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম'। বাংলার ইতিহাস-চর্চার প্রধান পাদপীঠ দেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই মিউজিয়াম। পাঁচ হাজার বছর আগের সিন্ধুসভ্যতা-সহ প্রায় ১৭ হাজার প্রত্ন-নিদর্শন রয়েছে এখানে। এতো প্রাচীন প্রত্ন-নিদর্শন বাংলাদেশের আর কোনো মিউজিয়ামে নেই। ১৯১০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অনানুষ্ঠানিক ভাবে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতি গঠিত হয়, আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা একই বছরের প্রতিষ্ঠা ২৭ সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠাতা নাটোর দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের সন্তান দয়ারামপুরের রাজা কুমার শরৎকুমার রায়। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান সমিতি পরে গড়ে তোলে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে এই মিউজিয়াম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান।
প্রায় ৭৫৩ একর বা ৩০৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইন্সটিটিউট, ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৬টি বিভাগে বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম৷ ক্যাম্পাসের উত্তর পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে ছাত্রদের জন্য ১১টি আবাসিক হল ৷ ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৬টি আবাসিক হল যা ক্যাম্পাসের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত৷ পূর্ব দিকে গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ডরমিটরি। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে রয়েছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা এদেশের সর্বপ্রথম স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।তাছাড়া রয়েছে সাবাস বাংলাদেশ নামে একটি ভাষ্কর্য৷ আরও রয়েছে গোল্ডেন জুবিলি টাওয়ার৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে তিনটি সাংবাদিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। ১৫টি সংগঠন নিয়ে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। বিজনেস স্টাডিজ ফ্যাকাল্টি ডিবেটিং ফোরাম (বিএফডিএফ) ও গোল্ড বংলা প্রধান দুটি বিতর্ক সংগঠন। এছাড়া আছে বিভিন্ন হল ভিত্তিক বিতর্ক ক্লাব। এখানে আইন বিভাগে একটি বিখ্যাত মুট কোর্ট সংগঠন রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে সচেতন বা সহায়তা করতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়তায় রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হায়ার স্টাডি ক্লাব । উদ্যোগ, বিজনেস এবং ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছে স্টার্ট-আপ আরইউ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক ফোরাম শিক্ষার্থীদের বই পাঠে মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা সহায়ক সুবিধা সাধারণ শিক্ষার্থী ও গবেষকদের শিক্ষা সহায়ক হিসেবে এখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরী, বিভাগীয় কম্পিউটার ল্যাব, ইন্সটিটিউট ও অনুষদ লাইব্রেরী, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও লাইব্রেরী এবং কম্পিউটার সেন্টার। সংস্কৃতি চর্চার জন্য রয়েছে শিক্ষক-ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং খেলাধুলার জন্য স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো রয়েছে।
অঙ্কে ভালো ছিলাম না কখনো।তারপরও অনেক হিসেব নিকেশ করে দেখলাম .. জীবনের যা প্রাপ্তি সব কিছুর মূলে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আমাদের প্রাণের স্পন্দন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন পিছনের সারির মানুষ। চলনে বলনে,কথাবার্তায় গেঁয়ো …. বুনো ছাপ্পর মারা !! অভাব ছিল আত্মবিশ্বাসের ... লাজুক,জবুথবু ! আমার মত একটা অযোগ্য গ্রাম্য ছেলেকে রাবি একটা পরিচয় দিয়েছে ,জড়তা কাটিয়ে উঠে আত্মবিশ্বাসের একটা জায়গা তৈরি করতে সাহায্য করেছে। জীবনকে নতুন করে চিনতে,বুঝতে,জানতে,আবিষ্কার করতে শিখলাম।সামনে চলার গোড়াপত্তন হল। প্রিয় শিক্ষক,রাবি’র বিশাল উদার পরিবেশ আর বন্ধুরা ছেঁটে ছুটে মসৃণতার একটা আবরণ দিয়েছে....পুঁজি ! যা ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছি এখনো! কৃতজ্ঞতার কি শেষ আছে! কাছের দূরের সবার জন্যে শুভ কামনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এলামনাইদের কর্মের মাধ্যমে স্ব-মহিমায় যুগ যুগ ধরে টিকে থাকুক। সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে এগিয়ে চলুক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
email: smh.mkt@[email protected]