শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার জাবি শিক্ষার্থী!


শরিফুল ইসলাম | Published: 2019-09-28 00:03:14 BdST | Updated: 2024-05-18 17:07:17 BdST

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের এক ছাত্রী। যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান এর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। লিখিত অভিযোগে বিস্তারিতভাবে শিক্ষকের হেনস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থী।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দাখিলের পর বিভাগ থেকে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ঐ ছাত্রী। তার লিখিত অভিযোগ পত্র থেকে জানা যায়, সানোয়ার সিরাজ ৩০৩ নং কোর্সের (কম্পারেটিভ পলিটিক্স অব লাতিন আমেরিকা) ক্লাস নিতেন। পরে ঐ শিক্ষার্থী মানোন্নয়ন পরীক্ষার দেওয়ার জন্য সানোয়ার সিরাজের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে সানোয়ার সিরাজ তাকে যৌনতার ইঙ্গিত দেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার প্রদান করেন এবং পরীক্ষায় ভাল মার্কস দিবে বলে আশ্বাস দিয়ে পরবর্তীতে যোগাযোগ করতে বলেন।

গত ১২ মার্চ, ২০১৮ তারিখে উনি নিজে ওই শিক্ষার্থীকে ফোন করেন এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাকে একসাথে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। শিক্ষকের এমন আচরণ দেখে শিক্ষার্থী হতবাক হয়ে, শিক্ষককে ফোন করে নিশ্চিত হন যে তার আইডি হ্যাক হয়েছে কিনা। পরে ওই শিক্ষক জানান, তিনি তার প্রতি আকর্ষণবোধ করেন এবং বহুদিন ধরে তাকে নোটিশ করছেন। এসব শুনে ঐ শিক্ষার্থী শিক্ষককে তিরস্কার করেন এবং ভবিষ্যতে এমন আচরণ করতে নিষেধ করেন। তবে নাছোড়বান্দা ওই শিক্ষক সেখানেই ক্ষান্ত হননি , তিনি তাকে ক্রমাগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের বার্তা পাঠাতেন। ওই পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ৪০৫ নং কোর্সের পরীক্ষার দিন সন্ধ্যা থেকে শিক্ষক তাকে ক্রমাগত ফোন কল দিয়েই যাচ্ছিল। একবার ধরে তার আপত্তিকর কথাবার্তা শুনে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন। সেই রাতেই তাকে মেসেঞ্জারে নক করে তার ফোন কল ধরতে বলেন সেই শিক্ষক। রুমমেটকে শিক্ষকের আচরণের ব্যাপারে আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিলেন সে শিক্ষার্থী।

এরকম উত্ত্যক্তকরনের স্বীকার হবার ফলে তিনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছিলেন না। এরকম অবস্থায় প্রচন্ড অসহায়ত্ববোধ থেকে তিনি কান্না শুরু করেন। এমন অবস্থায় রুমমেট কি হয়েছে জানতে চাইলে তাকে পুরো বিষয় খুলে বলেন সেই শিক্ষার্থী। তার রুমমেট ওই শিক্ষককে এড়িয়ে চলতে অনুরোধ করেন এবং তাকে বলেন যে এ কারণে তার পরীক্ষায় কম নাম্বার আসতে পারে বলে সতর্ক করেন। পরবর্তীতে ওই শিক্ষার্থী সানোয়ার সিরাজের এসব আপত্তিকর আচরণ তার পরিচিত বন্ধু, শিক্ষক এবং এক কর্মকর্তাসহ অনেককেই জানান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরামর্শ দেন অনেকে। সবাই তাকে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি পুনরায় রুমমেটের পরামর্শে সেদিন রাতে শিক্ষকের ফোন ধরেন। শিক্ষক তাকে বলেন, ‘আমি তোমার সবকিছু খেয়াল করি। তুমি একই ড্রেস পড়ে পাঁচটা পরীক্ষা দিচ্ছো। আমি তোমাকে দুইটা ড্রেস গিফট করতে চাই। তুমি না করতে পারবে না।‘ তিনি তাকে গ্লোরিয়া জিনস ও ন্যান্দোস এ খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন এবং ভুক্তভোগী প্রত্যাখ্যান করলে অভিযুক্ত বলেন, ওহ তোমার তো পরীক্ষা, ঢাকা যেতে পারবে না, লন্ডোনাস রেস্টুরেন্টে চলো’, সম্ভব নয় বলার পর তিনি তাকে বলেন, ‘আগামীকাল রাতে তোমার খাতা দেখবো। তাই তুমি তোমার রোল নম্বর পাঠিয়ে দাও।’

তার এসব কথা না শুনার ভান করে এড়িয়ে যেতে চাইলে তিনি ওই শিক্ষার্থীকে বলেন, ‘কাল সন্ধ্যায় একটু সাজগোজ করে আমার সাথে বেড়াতে চলো, তোমার সাথে ঘুরতে চাই।‘ শিক্ষার্থী প্রত্যাখ্যান করলে পুনরায় বলেন,’আজ রাতে আমার স্ত্রী বাসায় নেই, তোমাকে জড়িয়ে সারারাত বসে থাকব। এক ঘন্টা ধরে তোমাকে টানা চুমু খেতে চাই।‘ তার এসব আচরণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে ওই শিক্ষার্থী বারবার তার শিক্ষক পরিচয় মনে করিয়ে দিয়ে বিরক্ত না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাও ওই শিক্ষক নাছোড়বান্দার মতো তার পেছনে লেগে থাকেন।

ভুক্তভোগী বিষয়গুলো ডা. প্রফেসর মো আলী হোসেন ও সৈয়দ আতিকুল হককে জানান। তারা জানান, তার যাবতীয় অসুস্থতা এরকম মানসিক নিপীড়নের ফলেই হচ্ছে। তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হতে জানান এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে অভিযোগ জানাতে বলেন। শিক্ষকের কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তার ৩০৩ নং কোর্সে কম নাম্বার প্রদান করেন ওই শিক্ষক। শিক্ষকদের এ বিষয়ে জানাতে গিয়ে শিক্ষক রাজনীতির স্বীকার হন এবং অধিকাংশ শিক্ষক উল্টো তার প্রতি বৈরী আচরন করেন। ভুক্তভোগী জানান তার কাছে ঐ শিক্ষকের সাথে হওয়া চ্যাটিং এবং ফোনকল রেকর্ড রয়েছে যেখানে ঐ শিক্ষক তাকে আপত্তিকর প্রস্তাব এবং আচরণ করে আসছিলেন।

তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতি খন্দকার শামসুন্নাহার বিভাগীয় গোপনীয়তার স্বার্থে বিভাগে সংরক্ষণ করার নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেন, তিনি আমাকে বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে নিশ্চয়তা প্রদান করে মেসেঞ্জার চ্যাটিংয়ের হার্ড কপিগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে নেন। অথচ তার আগে বিভাগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ক্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি ভুক্তভোগীর উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি তার সমাপনী বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এটা ওপেন এবং পাবলিক ফোরাম; এখানে একজন ছাত্রী এখানে যেসব অভিযোগ করছে সেসব বিভাগের মান সম্মানের সাথে জড়িত। এখানে তার দেওয়া দেওয়া অভিযোগ তথ্য প্রমাণের সাপেক্ষে লিখিতভাবে জানাতে হবে। তা না হলে ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।’

উল্লেখ্য, এক বছর পূর্বে সানোয়ার সিরাজের স্ত্রী শাহনেওয়াজ পারভীন ভুক্তভোগীর হলে বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে তাকে জানান, সানোয়ার সিরাজ তাকে নির্যাতন করে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪২ ব্যাচের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে ঢাকায় বসবাস করছেন। এবং তিনি এও জানতে পারেন, ওই শিক্ষইক একাধিক ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত। সেসব মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে অশিক্ষকমূলক আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সাক্ষ্য দিতে।

এদিকে অভিযুক্ত সানোয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে এর আগেও তার স্ত্রী একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে 'অনৈতিক' সম্পর্কের অভিযোগ এনেছিলেন।

এ বিষয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি সাথে যোগাযোগ করা হলে বিভাগের বর্তমান সভাপতি নাসরিন সুলতানা বলেন, 'আমি গত ১৯ তারিখ অভিযোগ পত্রটি পেয়েছি। কিন্তু তার কিছু প্রমাণপত্র আমাকে দেওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীতে আমি গত ২৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে হস্তান্তর করি।'

এসএস/ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯