ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে না কেন?


ঢাবি টাইমস | Published: 2019-11-29 23:55:48 BdST | Updated: 2024-05-19 16:48:15 BdST

প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালেও একসময়ের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না।

বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারলে এই সমালোচনার ব্যাপকতাও বাড়ে।

যদিও সংশ্লিষ্টিরা বলছেন, বিদেশি শিক্ষার্থী থাকা বা না থাকা র‌্যাংকিংয়ে কোনো প্রভাব ফেলে। না।

তাদের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ পরিচিতি না থাকা, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত আবাসনের অভাব, ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা, জটিল ভর্তি প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি ‘অফিস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’ এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ৪৯ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন মেডিকেল, ডেন্টাল ও অন্যান্য কলেজ মিলিয়ে সংখ্যাটি আট হাজারের বেশি বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থীরা স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী, ওই হলে এখন ১২৯ জন বিদেশি ছাত্র রয়েছে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে ছাত্র আছে ১৫ জন, বাকিরা অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। ওই হলে বিভিন্ন বিভাগের ৫৩ জন শিক্ষকও থাকেন।

অধ্যাপক ইমতিয়াজের মতে, বর্তমানে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারে কম না হলেও আরও বাড়ানো উচিত।

প্রচারের অভাবকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ না বাড়ার অন্যতম কারণ মনে করেন তিনি।

“আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির ক্ষেত্রে যেভাবে প্রচার চালায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অর্থে তেমন প্রচার নেই। এখানে কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে বা কী কী বিষয়ের ওপর লেকচার দেওয়া হয়, কোন কোন বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া যাবে, এই বিষয়গুলোর প্রচারে যথেষ্ট ঘাটতি আছে।”

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘নেতিবাচক’ সংবাদকেও দায়ী করেন এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে যেহেতু মিডিয়াতে বেশিরভাগ নেগেটিভ নিউজ হয়, তো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও যখন নেগেটিভ নিউজ হয়, আর এখন যেহেতু ইন্টারনেটের যুগ, বেশিরভাগই ওই নেগেটিভ নিউজটাই পড়ে। নেগেটিভ নিউজে দেখা হচ্ছে, এখানে মারামারি হচ্ছে, হলে গণ্ডগোল হচ্ছে, এখানে ছাত্ররা মাঝে মাঝে সংঘর্ষে নেমে পড়ে- এইসব নেগেটিভ নিউজের ফলে অনেক বিদেশি মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

“অনেকের ভুল ধারণা আছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হলে বাংলা জানতে হবে। তারা এটা চিন্তা করে না যে, এখানে অনেক বিভাগে ইংরেজিতেই পড়ানো হয়। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও যে বৈচিত্র্য আছে, সেটাও অনেকে জানে না। কারণ এগুলোর কোনো প্রচার নেই। এসবও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”

বিদেশি শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধাও দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

“অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী যেহেতু আবাসনের বিষয়েও গুরুত্ব দেয়, আর সবসময় আমরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা হলে তাদের জায়গা দিতে পারি না তাই এটাও অনেকে চিন্তা করে। আর ঢাকায় বসবাসের খরচও এখন বেশি। এক্ষেত্রে একেবারে ইউরোপীয় যারা আছে তাদের ক্ষেত্রে সস্তা হতে পারে কিন্তু প্রতিবেশী দেশ থেকে যদি কেউ আসতে চায় তাহলে দেখা যায় তাদের জন্য এই ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণেও অনেকের আগ্রহ নষ্ট হয়।”

বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাকেও দায়ী করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

তিনি বলেন, “আমাদের বিদেশি ছাত্র নেওয়ার প্রসেসটা খুব দীর্ঘ। অনেক বিদেশি হয়ত আবেদন করল, কিন্তু এত সময় নেয় যে, তারা তখন অন্য পথ দেখে বা অন্য দেশে চলে যায়। আমার মনে হয়, এই সিস্টেমটাও চেঞ্জ করা দরকার। বিদেশি শিক্ষার্থীরা আবেদন করলে সে যদি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসে সেটাই যথেষ্ট হওয়া উচিত।”

ভর্তিচ্ছু বিদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণত প্রথমে ই-মেইলেই যোগাযোগ হয়ে থাকে। এ কাজটি করে থাকেন মূলত ডেপুটি রেজিস্ট্রার (ইন্টারন্যাশন্যাল স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স) শিউলি আফছার। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাকে।

তিনি বলেন, “বিদেশি শিক্ষার্থীরা এখানে আধুনিক ডরমেটরি চায়, এসি রুম চায়, এসি হল চায়। এসব তো আমাদের নেই। আবার অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তি বা আর্থিক সাপোর্ট চায়, কিন্তু তা দেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও প্রচারের অভাব আছে। তবুও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি কনভিন্স করে শিক্ষার্থীটিকে ভর্তি করাতে।“

ভর্তিচ্ছু বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাহিদা সংক্রান্ত কিছু ই-মেইলের কপিও দেখান তিনি।

অধ্যাপক ইমতিয়াজের মতো শিউলি আফছারও বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিলতার কথা বলেন।

“একজন বিদেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে হলে তাকে এনওসি পেতে হয়। এই এনওসি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এনওসি এসবির ইনভেসটিগেশন হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়। এরপরেই একজন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে। আবার ভর্তির পর ওই শিক্ষার্থীর ভিসা প্রতিবছর বৃদ্ধি করতে হয়। এজন্য পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়। সবকিছু মিলে একজন বিদেশি শিক্ষার্থীকে এইসব দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে হয়রান হতে হয়।

‘“আবার শুধু বিদেশি হলেই একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক যোগ্য বিবেচিত হলেই কেবল ভর্তি হতে পারে। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর অনেক সময় সিজিপিএ কম বা ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী হওয়ার ফলে তার ভর্তি আবেদন বাতিল করতে হয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি বিভাগ থেকে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করছেন নেপালী শিক্ষার্থী পিন্টু কুমার সাহা। তিনি স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলেই থাকছেন।

বাংলা বলায় পারদর্শী এই শিক্ষার্থী বলেন, “ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ছোট-ছোট কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাঝে মাঝে কাউন্সেলিং করলে ভালো হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যার বিষয়গুলো বলতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়তা করবে।”

বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করেন, প্রচারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই যেহেতু একটা নেভেটিভ ইমেজ তৈরি হয়েছে এইটাকে ভাঙ্গা দরকার। এখানে যে গবেষণা হয় সেটা অনেকে জানে না, এখানে যে একাধিক ফেলোশিপ আছে সেটাও অনেকে জানে না।

“তাই আমি মনে করি, একটা হল জ্ঞানের অভাব আর একটা হল পরিবেশ। এই জায়গায় যদি আমরা একটু মনোযোগী হতে পারি এবং দলীয় রাজনীতি একটু আমরা কমাতে পারি, মোটামুটি একটা শৃঙ্খলার মধ্যে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটাকে রাখা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে আমি মনে করি যে বিদেশি শিক্ষার্থী আরও বাড়বে।”

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, “যে বক্তব্যগুলো আসছে, এগুলো একটাও অমূলক নয়। আমরা সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, সংস্কার এবং সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আর প্রচারের যে ঘাটতি, এটাও সত্য। এটি কিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় এই ব্যাপারেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

“আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্র্যান্ডিং করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি স্ট্রেন্থ আছে, প্রসপেক্ট আছে সেগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার জন্য আমরা পদক্ষেপ হিসেবেই অফিস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স করে দিয়েছি। যেটি আগে শুধু ডেস্ক আকারে ছিল।”

বিদেশি শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে ইতোমধ্যে একটি তহবিল চেয়ে আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মুজিববর্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষকে সামনে রেখে আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি একটি বিশেষ তহবিল দিতে, যাতে আমরা বিদেশি ছাত্রদের সহায়তা করতে পারি।”

উপাচার্য বলেন, “আমাদের নতুন হল যখন হবে বা কোনো কিছু সম্প্রসারণ করব তখন আমরা কোনো একটা অংশ বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ রাখব। এটা হতে পারে কিছু রুম, বা কোনো একটা ব্লক বা হাউজ, যেগুলোর ইনটেরিয়র ডিজাইন হয়তো একটু ভিন্নভাবে আমরা করে দেব।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম