রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রয়েছে পৃথক আবাসন ব্যবস্থা। এখন যার অধিকাংশই খালি পরে আছে। নিরাপত্তাহীনতা, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব, অতিরিক্ত ভাড়া, নিয়মিত সংস্কার না করাসহ বিভিন্ন কারণে কোয়ার্টারে থাকতে চান না বলে জানান শিক্ষক-কর্মকর্তারা। কোয়ার্টারগুলোতে না থাকার ফলে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে এটাকে একাডেমিক ক্ষতি বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শিক্ষক-কর্মকর্তারা জানান, নীতিমালা অনুযায়ী প্রভাষক ও কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে মূল বেতনের ৪০ শতাংশ এবং অধ্যাপক ক্যাটাগরির শিক্ষকদের ৩৫ শতাংশ হিসাবে ভাড়া দিতে হয়। যা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আবার কাউকে গুনতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। যা দিয়ে শহরে যে কোনো ভালো বাসায় থাকা যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখে যায়, কোয়ার্টারগুলোর রাস্তার দুইপাশে অধিকাংশ ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে। কিছু কিছু বাসার জানালা ভেঙে পরে আছে, নেই দরজা। বাসার জানালা-দরজায় লেগে আছে উইপোকা। বাসাগুলোর ওপরের তলাগুলো ঠিক থাকলেও নিচের তলা পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে আছে। বাসাগুলোর পশ্চিম পাশের প্রাচীর ভেঙে গেছে। এছাড়াও বাসাগুলোতে কোনো দারোয়ান বা গার্ড চোখে পরেনি। কিছু কিছু বাসার দেয়াল থেকে সিমেন্ট বালু খসে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট বাসা বা কোয়ার্টার আছে ৩১৪টি। এর মধ্যে ১২০টি বাসা খালি পড়ে আছে। সহায়ক, সাধারণ ও সুইপারদের ১৫০টি বাসার মধ্যে ৫৭টি খালি। সহায়ক শ্রেণিদের জন্য নির্ধারিত ৩৬টি বাসার মধ্যে ১৭টিতে কর্মচারীরা বসবাস করলেও ১৯টি খালি পড়ে আছে। সাধারণ শ্রেণিদের ৫৪টি বাসার মধ্যে ৩৮টিতেই কেউ থাকেন না।
দীর্ঘদিন শিক্ষকদের কোয়ার্টার নিয়ে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. মো. কুদরত-ই- জাহান। শনিবার সকালে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, কোয়ার্টারগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। পোকামাকড়ও পাওয়া যায় এবং সিকিউরিটি গার্ডেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হলো অর্থনৈতিক। বাসা ভাড়া হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা কেটে নেয় যেটা মান অনুযায়ী অনেক বেশি। যার জন্য প্রায় অধিকাংশ বাসা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে টাকা কেটে নেয় তার এক চতুর্থাংশ টাকায় বাইরে ফ্লাট নিয়ে থাকা যায়।
শিক্ষকদের আবাসিকমুখী করার জন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে এ বিষয়ে তিনি বলেন, কোয়ার্টারগুলোর মান অনুযায়ী ভাগ করে যুক্তিসংগত ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত।
রাবির আবাসিক এলাকায় থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, বর্তমানে কোয়ার্টারের বাসাগুলোতে থাকার অনুপযোগী হয়ে গেছে। বাসাগুলোতে উইপোকা ও সাপের আস্তানা হয়ে গেছে। এছাড়াও পশ্চিম পাশে রাস্তার কাজ করার সময় প্রাচীর ভেঙে ফেলায় হরহামেশাই চুরি হয়ে যাচ্ছে জিনিসপত্র। বাসাগুলোতে কোনো কেয়ারটেকার বা দারোয়ান নাই। যার জন্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয়। এছাড়া বর্তমানে যে পরিমাণ ভাড়া দিয়ে কোয়ার্টারে থাকতে হয় তা দিয়ে বাইরে অনায়াসে ভালো বাসায় থাকা সম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে প্রশাসন, ইউজিসিকে জানানো হলেও কোনো সমাধান মিলছে না। যার ফলে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কোয়ার্টারগুলো।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী বলেন, শিক্ষকদের বাইরে থাকার ব্যাপারে আমি মনে করি একপ্রকার জোর করেই তাদেরকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে। নিম্নমানের বাসায় উচ্চমানের ভাড়া রাখাটা তারই নামান্তর। কিন্তু এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় নেই বরং অর্থ-মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করছে। সরকারকে এটা ভাবা উচিত অতিরিক্ত ভাড়া নিতে চাওয়ায় শিক্ষকগণ বাইরে থাকলে তাদের লাভ হচ্ছে না বরং লোকসান হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি বোঝানো কিন্তু আমার মনে হয় তারা সেটা করতে ব্যর্থ।
কোয়ার্টারগুলো চোরদের রাজত্ব হয়ে গেছে তুলে ধরে বলেন, বাসা থেকে মূল্যবান সামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে। ভবনের একদিকে দেয়ালগুলো তোলা হয়নি অন্যদিকে অধিকাংশ বাসা পরিত্যক্ত। এমনকি উপরের ফ্ল্যাটে থাকা অবস্থাতে নিচতলা থেকে চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে।
এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড মো. সুলতান-উল-ইসলাম আর্থিক ক্ষতি ও একাডেমিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারগুলো ফাঁকা হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। একজন সিনিয়র শিক্ষকের বেতনের ৩১ হাজার টাকা দিতে হয়। কোয়ার্টারগুলো মান ভালো থাকলে হয়ত এই টাকা দিয়ে শিক্ষকরা বাসাগুলোতে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে জমি কিনে বাড়ি করছে। এছাড়াও শিক্ষকরা তাদের সাধ্যের মধ্যে বাইরে ভালো মানের বাসায় থাকতে পারছেন। এইজন্য দিন দিন কোয়ার্টারগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ক্ষতি ও একাডেমিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
শিক্ষকদের কোয়ার্টার মুখী করতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের থেকে পরামর্শ নিয়েছি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় শিক্ষক সমিতি আমাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমরা মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠিয়েছি। কয়েকদিন আগে একটা চিঠির উত্তরও এসেছে। সেখানে সরকার বলেছে আগের নীতিমালা অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত থাকবে। এই নীতিমালার কোনো পরিবর্তন হবে না। শিক্ষকদের থাকতে হলে এই নীতিমালা অনুযায়ী থাকতে হবে। সূত্র : ঢাকা পোস্ট