সংবিধানের চার মূলনীতির স্বাক্ষী দেশের একমাত্র শহিদ মিনার


Shoeb Shuvro | Published: 2024-02-21 18:27:34 BdST | Updated: 2024-12-10 23:35:30 BdST

পৃথিবীতে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাঙালি জাতির আত্মাহুতি দেয়ার ঘটনা বিরল। এ জন্য জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। সেই গর্ব, সেই অহঙ্কার নিয়ে বাংলা ও বাঙালির ভাষাগত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে এগিয়ে নেয়ার সার্বক্ষণিক চেষ্টাই করতে হবে আমাদের। যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণীয় করে রাখতে মানুষ নির্মাণ করে স্মৃতিস্তম্ভ। এর মাধ্যমে ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক সহজ হয়, সরল হয়ে যায় অমর ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানানোর কঠিন কাজটাও। সেজন্যই '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন যারা, তাদের স্মরণে নির্মিত হয় শহিদ মিনার। আর তার মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

তেমনি এক অনন্য ব্যতিক্রমধর্মী শহিদ মিনার যেটি সংবিধানের চারটি মূলনীতি ধারণ করে রয়েছে। বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কথা। মিনারটিতে রয়েছে চারটি স্তম্ভ যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্দেশ করছে। ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক’ শীর্ষক একটি প্রকাশনা থেকে জানা যায়, দেশের অন্যান্য শহিদ মিনারের গড়নের দিক থেকে আলাদা এটি।

ছয় কোণা প্ল্যাটফর্মের ওপর লম্বা চারটি স্তম্ভ দিয়ে তৈরি শহিদ মিনারটি। যার নকশা করেন স্থপতি খায়রুল এনাম। ১৯৭২ সালের ৯ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী এর উদ্বোধন করেন।

এ শহিদ মিনারে রয়েছে চারটি বাহু যা উল্লম্বভাবে উঠে গেছে উপরের দিকে। বাহু চারটি উপরের দিকে বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ। এর প্ল্যাটফর্মটি কৃত্রিমভাবে তৈরি মাটির টিলার ওপর অবস্থিত। ফলে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় শহিদ মিনারের মূল ভিত্তিতে। শহিদ মিনারটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এর ম্যুরাল চিত্র, শহিদস্মৃতি সংগ্রহশালা, উন্মুক্ত মঞ্চ, সুবিস্তৃত খোলা প্রান্তর এবং ফুলর বাগান। আর এসব কিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে অনন্য এই শহিদ মিনার চত্বর।

রাবিতে নির্মিত শহিদ মিনারের মূল স্তম্ভটির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক খায়রুল এনাম বলেন, "রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের প্রথম ডিজাইনটি আমি করেছিলাম। চারটি মূলনীতিকে ফোকাস করেই এই ডিজাইনটি করা হয়েছিল। তবে কাজটি আমি শেষ করতে পারিনি; মূল নকশাটিকে ঠিক রেখে কিছুটা পরিবর্তন করে আরেকজন আর্কিটেক্ট এই শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজটি শেষ করেছিলেন।"

কেন সংবিধানের চারটি মূলনীতিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল?—এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক এনাম বলেন, "স্বাধীনতা থেকে আরম্ভ করে আমাদের যে স্যাক্রিফাইস, আমাদের দেশকে ডেভেলপ করা এবং বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের নেতৃত্ব—এই বিষয়গুলো আমাদের মাথায় ছিল। দেশের সংবিধান প্রণয়ণের কাজটিও তখন চলছিল এবং সেখানে চারটি মূলনীতির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই চারটি মূলনীতিকে থিম ধরে এই শহিদ মিনারের ডিজাইনটি দেওয়া হয়।"

মিনারের ঠিক পিছনের দিকেই এক স্নেহময়ী মা ও তার সন্তানদের অবয়ব প্রকাশ করছে এমন একটি ম্যুরাল চিত্র রয়েছে। অক্ষয়বট শীর্ষক ম্যুরালটি নানা বর্ণের পোড়া ইট ও পাথরের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়। ম্যুরালটি সূর্যের উপস্থিতিতে শহীদ সন্তানদের বীরত্বকে উপস্থাপন করে। এছাড়া মায়ের অঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শহিদদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেখানে। গঠনশৈলী এবং উপাদানের বৈচিত্র্যে অনন্য এ ম্যুরালটি নির্মাণ করেছেন শিল্পী মর্তুজা বশীর।

এদিকে, শহিদ মিনারের পাদদেশে রয়েছে শহিদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। এ সংগ্রহশালার ডিজাইন করেন স্থপতি মাহবুবুল হক। সংগ্রহশালায় রয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলির আলোকচিত্র, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নানা শিল্পকর্ম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আলোকচিত্র, তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র।

সংগ্রহশালার কোল ঘেঁষে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। এর পেছনের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রাম বাংলার আবহমান দৃশ্য। এটি নির্মাণ করেন শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়। এ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- যার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের ধারা। সর্বোপরি ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দর্শনার্থীদের এক প্রাণের মেলবন্ধন এই শহিদ মিনার চত্বর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই শহিদ মিনারটিকে স্বাধীনতার পর নির্মিত দেশের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে মনে করেন।