আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধের দামামা


Dhaka | Published: 2020-07-18 16:41:16 BdST | Updated: 2024-05-18 14:20:03 BdST

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই মধ্য এশিয়ার দুই বৈরি প্রতিবেশী আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরুর গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত ১০ জুলাই থেকে আর্মেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমের তাভুশ সীমান্তে দুই দেশের সৈন্যরা ট্যাংক ও কামানের মত ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে।

আজারবাইজানের সরকারি হিসাবেই একজন মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্কের কর্মকর্তাসহ তাদের ১১ জন সৈন্য মারা গেছে। আর্মেনিয়া স্বীকার করেছে যে, একজন মেজর এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ তাদের চারজন সৈন্য মারা গেছে, যদিও আলজেরিয়া দাবি করছে, ওই সংখ্যা শতশত।

উভয় পক্ষই বলছে, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতেও গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে, যাতে মানুষজন মারা যাচ্ছে।

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার হুমকি

রুশ পত্রিকা প্রাভদা আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কর্নেল ভাজিফ দারগিয়াখিলকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, আজারবাইজানের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো স্থাপনায় হামলা হলে আর্মেনিয়ার মেটসামোর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে।

ওই মুখপাত্র বলেন, ‘আর্মেনিয়া যেন মনে রাখে যে, আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে এমন সব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে যা নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। আমাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিশেষ করে মিনগেচভিক জলাধারে আঘাত করলে, আর্মেনিয়াকে তার ভয়াবহ দুর্ভোগের স্বীকার হতে হবে।’

মঙ্গলবার রাতে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে জারি বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করই হাজার হাজার মানুষ সহিংস বিক্ষোভ করে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর দাবি তোলেন। জাতীয় পতাকা নিয়ে মানুষজন ‘নাগোরনো কারাবাখ আজারবাইজানের‘ এবং ‘দ্রুত সৈন্য পাঠাও’ স্লোগান দিচ্ছে।

এ ধরনের পরিস্থিতির পর আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন’ এবং তিনি দুই দেশের মধ্যে দ্রুত শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, আজারবাইজানকে রক্ষার জন্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না তিনি।

দুই প্রতিবেশীর শত্রুতার ইতিহাস

নাগোরনো কারাবাখ নামে বিতর্কিত একটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুসলিম আজারবাইজান এবং খ্রিস্টান সংখ্যাগুরু আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। এই দুই দেশই এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখনও নাগোরনো কারাবাখ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল।

ওই সময় অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ হিসেবে থাকলেও সেখানকার জনসংখ্যার সিংহভাগই জাতিগতভাবে আর্মেনিয়, আর সেটাই সমস্যার মূলে।

সোভিয়েত আমলে নাগোরনো কারাবাখ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে আজারবাইজান নাগোরনো কারাবাখের আঞ্চলিক সরকারকে উৎখাত করে।

ওই ঘটনার পরপরই সেখানকার জাতিগত আর্মেনিয়রা কার্যত বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। নাগোরনো কারাবাখের আঞ্চলিক পার্লামেন্টে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ভোট করে আর্মেনিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয়ে যায় ওই এলাকার আজেরি এবং আর্মেনিয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর ১৯৯২ সালের শীতে জাতিগত ওই সংঘাত স্বাধীন আজারবাইজন এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে পুরাদস্তুর যুদ্ধের রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে আজারবাইজান থেকে প্রায় আড়াই লাখের মত আর্মেনিয় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে নাগোরনো কারাবাখ ছাড়তে হয়েছিল প্রায় লাখখানেক আজেরিকে।

আজারবাইজানের সীমান্ত শহর তোভুজে আর্মেনিয় গোলায় বিধ্বস্ত একটি বাড়ির বাসিন্দাদের সাথে কথা বলছেন স্থানীয় এমপি

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতি হলেও আর্মেনিয়া নাগোরনো কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়ে সেখানে জাতিগত আর্মেনিয়দের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। নাগোরনো কারাবাখ আজারবাইজানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অংশ হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ আর্মেনিয়ার হাতে যা আজেরিরা কখনই মেনে নেয়নি।

ফলে যুদ্ধবিরতি মাঝে মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ে এবং ২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে চারদিনের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় যা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে থামে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চার বছর বাদে আবারও পুরোদস্তুর একটি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।

মহামারির মধ্যেও বিপজ্জনক এই পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?

১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির পর থেকে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ নামে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নাগোরনো কারাবাখ সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি আপোষ মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিবিসির ককেশাস অঞ্চল বিষয়ক সংবাদদাতা রেয়হান দিমিত্রিভ বলছেন, গত তিন দশক ধরে পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি না হওয়া নিয়ে আজারবাইজানের মধ্যে হতাশা দিনদিন বাড়ছে। ‘আজেরিরা দেখছে যুদ্ধের তিন দশক পরও নাগোরনো কারাবাখ এবং আজারবাইজানের কমপক্ষে সাতটি দখল হয়ে যাওয়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে আর্মেনিয়া।’

গত সপ্তাহের আজেরি প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ খোলাখুলি বলেন, আন্তর্জাতিক এই মীমাংসা অর্থহীন। তার দুদিন না যেতেই সীমান্তে শুরু হয় এই লড়াই।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নব্বই দশকের তুলনায় আজারবাইজানের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি এখন অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৭ সালে আজারবাইজান সামরিক খাতে যে ব্যয় করেছে তা আর্মেনিয়ার পুরো বছরের বাজেট। ফলে, আজেরিদের মধ্যে নাগোরনো কারাবাখের বাস্তবতা পরিবর্তনের সংকল্প শক্ত হচ্ছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা