তারুণ্যের ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু  


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2017-08-16 22:03:32 BdST | Updated: 2024-04-28 02:33:17 BdST

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাইম : টুঙ্গিপাড়া ছিল তখনকার ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত গোপালগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রাম। সেই গ্রামের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান ৩৪ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে কৃষি ও বনমন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালে তিনি বিখ্যাত ছয় দফা দাবি পেশ করেন। একাত্তরের সাতই মার্চে যাঁর আহ্বানে সারা দিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট।

বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই তারুণ্যময় কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কারণ, তরুণরাই পারে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। তরুণদের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। বাঙালির হাজার বছরের জীবন-কাঁপানো ইতিহাস হচ্ছে স্বাধীনতা, যা আমাদের ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় অর্জন। বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার শক্তি আর বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনাকে বুকে ধারণ করেও এখনো আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। স্বদেশবিরোধী কুচক্রী মহলের কর্মকাণ্ডে, আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ও সোনার বাংলা গড়ায় বড় ধরনের বাধা।

১৯৪০ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে ভরা এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা-চেতনার পরিধি মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর- এ দুটি পর্বে বিশ্লেষণ জরুরি। একইভাবে কী কী কারণে তরুণদের কাছে তিনি অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব, সে ব্যাখ্যার জন্য এ দুই পর্বে তাঁর কর্মময় জীবন ও নীতি-আদর্শ তুলে ধরা দরকার। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার শেখবাড়িতে যে শিশুটি জম্মগ্রহণ করেন, তিনি পরবর্তী সময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত হন বিশ্বব্যাপী। তিনি তরুণ বয়সে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত একটানা জেলে বন্দি ছিলেন জনপ্রিয় এই তরুণ নেতা। তবে জেল-জুলুমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলনে ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির জনক ও বিশ্ব নেতৃত্বে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনায় গণমানুষের নেতা হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব পান। একই সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি...আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাস ও শেখ মুজিব দুটো অবিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে ওঠে। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিচরিত্র একটি অখণ্ড সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে চি‎হ্নিত।

তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। এ কারণে মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবনদর্শনকে একীভূত করে নিয়েছেন তিনি। ইতিহাস লুকিয়ে রাখা যায় কিংবা বিকৃত করা যায়। কিন্তু চিরন্তন সত্য হলো ইতিহাস কোনো-না-কোনোভাবেই প্রকাশিত হয় তার আপন নিয়মে। এ সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তাদের মনের অজান্তে লুকিয়ে থাকা দেশপ্রেমের তাগিদে একুশে ফেব্রুয়ারিতে, সাতই মার্চে, ষোলোই ডিসেম্বরে। দেশকে ভালোবেসে এ দিনগুলো তারা লাল-সবুজ পতাকাকে নানাভাবে সঙ্গে নিয়ে উৎসবে মুখরিত হয়, স্বাধীনতার গৌরবে গৌরাবান্বিত হয়ে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহান ব্যক্তিত্ব। তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে তারা তাদের জাতির পিতার মহানুভবতার কথা জানে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম। একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার অতীত ইতিহাস, বর্তমান কর্মকাণ্ড আর আগামী প্রজন্মের ভাবনার ওপর। এ দেশের জনগণ এখন উপলব্ধি করতে পারে আমাদের ইতিহাস ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ দীর্ঘকাল ধরে কীভাবে অবহেলিত ও অসম্মানিত হয়ে আসছে। তরুণ সমাজ বুঝতে পেরেছে, কীভাবে তারা তাদের পরিবার, শিক্ষক ও নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য পেয়ে আসছিল। সকলেই তাদের নিজস্ব মতামতের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তরুণ সমাজ নিজস্ব ধারণার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাদের শিক্ষক বা পিতামাতা আর তাদের প্রভাবিত করতে পারে না।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রার কাজ করবে। তাই এই তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাহলে বাংলার মাটিতে জন্ম হবে হাজারো বঙ্গবন্ধুর, যারা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দেবে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং এনে দেবে মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা আর দূর করবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হানাহানিকে।

লেখাটি শেষ করছি একজন খ্যাতিমান লেখকের উক্তি দিয়ে। কখনো তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন না। তিনি ১৯৯৪ সালে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে চট্টগ্রাম বিজয়মেলায় স্মারক গ্রন্থে লিখেছেন, আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : আইনজীবী ও রাজনীতিক।
সদস্য, কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগ।
(আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপির ছেলে)।

 

এমএসএল