হতাশা ও আত্মহত্যা নিয়ে আরো বেশি গবেষণা আবশ্যক


Dhaka | Published: 2020-06-15 16:32:03 BdST | Updated: 2024-09-29 04:48:26 BdST

বলিউডের খ্যাতিমান তারকা সুশান্ত রাজপুত আত্মহত্যা করেছেন। এটি কোন সাধারণ ও কাঙ্খিত খবর নয়। প্রতিষ্ঠিত অনেক তারকা, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও লেখক-কবিদের আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। ভারতে এর আগে আরো একটি আত্মহত্যার খবর এসেছিল। তিনি ছিলেন অভিনেত্রী জিয়া খান। কদিন আগে জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থ মন্ত্রীও আত্মহত্যা করেছেন করোনাকালীন অর্থনীতির নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে। হতাশা বা ডিপ্রেশন কখন কার ভেতর ঠিক কিভাবে ও কখন এক ধরণের দখলদারিত্ব তৈরী করে তা অনুমান করা কঠিন। তবে এ বিষয়টিকে আমরা বোধহয় এড়িয়ে যাচ্ছি বা অবমূল্যায়ন করছি। আমাদের উচিত হতাশা ও আত্মহত্যা নিয়ে আরো বেশি গবেষণা করা।

মনোবিজ্ঞানীগণ সব সময়ই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাদের কাজে কর্মে ও লেখনিতে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা এই বিষয়টি নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাই না, এরও যে চিকিৎসা প্রয়োজন আছে তা উপলব্ধি করি না। সফলতার পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুলেই যাই সফলতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার এবং এটি মরিচিকার মতো কেবল পিছেই সরে যায়। তার যতই কাছে যাওয়া যায় সে ততই দূরে চলে যায়। আত্মহত্যা নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানে প্রচুর পড়াশোনা আছে। তবে ফ্রেঞ্চ সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যার তত্ত¡ ও শ্রেণি বিণ্যাসের যে ধারণা দিয়েছেন তা বেশ নন্দিত। তিনি আত্মহত্যাকে ভিকটিমের ব্যক্তিগত দায় বলতে চান নি। তিনি মনে করেন এটি একটি সামাজিক প্রপঞ্চ। একজন মানুষ যখন সামাজিক ভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন, অবমূল্যায়িত, অবাঞ্চিত মনে করেন তখন তিনি আত্মহত্যা সংঘটন করতে পারেন। এমিল ডুর্খেইমের আত্মহত্যার শ্রেণি বিভাগের মধ্যে অনেক ধরণের আত্মহত্যার কথা বলা আছে যেখানে উল্লেখ রয়েছে ইগোর কথা, বিচ্ছিন্নতার কথা, শোষন বঞ্চনার কথা। অবাকভাবেই পরিলক্ষিত হয় যে সুশান্তের এ ধরণের বিচ্ছিন্নতা বা দ্ব›দ্ব থাকার কথা। সে আপাত দৃষ্টিতে সফল ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যাক্তিত্ব। জীবনকে উপভোগ করার মতো নানা উপকরণে তার চারপাশ সুসজ্জিত। থমাস জয়নার ও ভ্যান অর্ডেন নামের একজন মনোবিজ্ঞানী ইন্টারপারসনাল থিওরি অব সুইসাডে বলেছেন ‘হতাশা ও নিজেকে বোঝা মনে করা’ আত্মহত্যার একটি বড় কারণ। অর্থাৎ ডুর্খেইম যখন মনে করেন এটি পুরোটাই সামাজিক, অর্ডেন মনে করেন এটি ব্যাক্তির মনোজাগতিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। তবে উভয়েই স্বীকার করেন যে ভিকটিমের এই মনোজাগতিক অবস্থার পেছনে সমাজের দায় রয়েছে। এ কারণেই আমার এই লেখার অবতারণা।

সুশান্ত রাজপুত আত্মহত্যা করেছে এটি প্রাথমিক ধারণা। তবে এটি নিয়ে অবশ্যই তদন্ত হবে হওয়া কথা। কেননা এরকম অনেক সুইসাইডের পরে এমন আলামত ও দাবী পাওয়া যায় যে এটি কোন সুইসাইড নয় বরং খুন। তাই তদন্ত হওয়ার কথা। তদন্ত কোন দিন শেষ হবে কিনা অনুমান করা কঠিন। কিন্তু যেটি আমি অনুধাবন করি সেটি হলো এই ধরণের অবাক করা আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর বিষয়ে তদন্তের চেয়ে গবেষণা বেশি জরূরী। কেন এই সুখী মানুষের মতো দেখতে লোকগুলো আত্মহত্যা করে? সুখী মানুষও আত্মহত্যা করে, এমন দাবী থাকলেও সেই সংখ্যা খুবই নগন্য এবং তা প্রমাণ শর্ত সাপেক্ষ। একজন অভিনেতার অভিনয় যেমন তরুণ ও যুব সমাজকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ভাবে প্রভাবিত করতে পারে তেমনই এই মানুষগুলো এমন কাজও আমাদের তিলে তিলে গড়ে তোলা সমাজকে নাড়িয়ে দিতে পারে। পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলে কোমলমতি শিশু বাচ্চারা পর্যন্ত আজকাল আত্মহত্যা করে। কোথা থেকে উদ্বুদ্ধ হয় তারা? কি বোঝে তারা ডিপ্রেশনের? এই ক্ষেত্রে আমি মনোবিজ্ঞানী রয় বোমেইস্টারের কথা স্মরণ করতে চাই। তিনি চমৎকার একটি রাস্তা দেখিয়েছেন আমাদের। তিনি বলেন, মানুষ কোথাও একটা পালিয়ে বাঁচতে চায়। মৃত্যু এখানে এক বেঁচে ওঠা।’ অপমান থেকে পালাতে চায়, খারাপ কোন পরিণতি থেকে পালাতে চায়। কিন্তু পালিয়ে বেড়ানোই এক মাত্র সমাধান নয়। মনোবিজ্ঞানীরা জানেন কিভাবে বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তারা আমাদের সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু আমরা তাদের দ্বারস্থ হই না। মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে অনেক দেশেই এখনো নেতিবাচক ধারণা রয়েই গেছে। সুশান্ত রাজপুর গত ছয় মাস ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। তার ডাক্তার এ বিষয়ে আমাদের আরো ভালো বলতে পারবেন। তার বলা উচিৎ। পরবর্তি প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে হলেও বলা উচিৎ। আমাদের দেশেও আত্মহত্যার প্রবণতা একেবারে কম নয়। তাই এ বিষয়ে আমাদেরও সচেতন হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

আমার দুটো অভিজ্ঞতা বলতে চাই। আমি নিজে একসময় কাউন্সেলিং করিয়েছি বিশেষ একটি কারণে। মানসিক সমস্যা এমন এক সমস্যা, এটা যার হয় সে জানে এর কি জ্বালা। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর মনে হয় এটা কোন অসুখই না। মানুষ নিজের সুখে থাকলে নিজের অসুখই স্বীকার করে না, অন্যেরটা করা তো কঠিনতর হবেই। সে সময় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নানা কারণে আমি বেশ হতাশ বোধ করতাম। কিন্তু কাউন্সেলিং এর পর একটা জাদুর মতো ফল পেয়েছিলাম। এখন আমি হেলাল হাফিজের কবিতার মতো বলে উঠি, ‘ এক জীবনের কতই বা আর নষ্ট হবে?’

দ্বিতীয় ঘটনাটি আমি যখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এসএসসি পরীক্ষার হল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি মেয়ে ভয়ে ও আতঙ্কে কিছুই লিখতে পারছিল না। আমি প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান যে মেয়েটি মানসিক রোগী। আমার কাছেও তাই মনে হলো। সে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে। সেই আত্মবিশ্বাসহীণতা থেকেই আসে হতাশা। আমাদের সমাজে অনেকে আছে যাদের হতাশায় ভোগার কারণ হলো, তারা কালো, তারা লম্বা নয়, তারা বেশি শুকনো, তারা সফল নয় (সরকারী চাকরি পায় নি)। এই সব কারণে তারা কারো সাথে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাটা পর্যন্ত বলতে চায় না। অথচ কতো সফল ও ফর্সা, লম্বা মানুষেরা হয়তো করোনা আক্রান্ত হয়ে তাদের আগেই মারা গেছেন। এ কারণে জীবনকে এতো সহজে মূল্যায়ন করতে নেই। পৃথিবীর কিছু দেশ আছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর আত্মহত্যা বৈধ। আশা করি সুশান্ত ইস্যুতে সেটি কেউ যুক্তি হিসেবে তুলে ধরবেন না যে ‘যার জীবন সে সিদ্ধান্ত নেবে সে বাঁচবে কিনা’। বরং বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান আমাদের দায়িত্ব।

অনেকেই বলছেন সুশান্ত সিং কিছুদিন হলো বলিউডে বন্ধুহীন হয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক তারকাদের ক্ষেত্রেই এটি হতে দেখা যায়। আসলে জীবনে বন্ধুর ধারণাটি ক্রমশই জটিল হয়ে যাচ্ছে। একটা নাটক, গান বা সিনেমা নিয়ে প্রচুর পলিটিক্সও হয় ভেতরে ভেতরে। অনেকেই বিনা কারণেও হয়ে পড়েন প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের বিরাগভাজন। কিন্তু এটি সব প্রফেশনের আছে। বেসরকারী চাকুরিতে ছাটাই হয়, সরকারী চাকুরিতে প্রমোশন আটকে যাওয়া ও দুর্গম জায়গায় পোস্টিং ইত্যাদি তো হরহামেশা হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতোই কর্মক্ষেত্রে আসলে স্থায়ী বন্ধু বলে কিছু নেই। সবার সাথেই কাজের সম্পর্ক। অর্জুন রামপাল বিভিন্ন সময় যে পরিমান খারাপ সময় ও সম্পর্কেরর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, গায়ক আতিফ আসলাম যে পরিমান অপমান সহ্য করেছেন প্রথম দিকে, তা নজিরবিহীন। আমি বলব এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকার ও পরিবারের মানুষদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা সফল। অনেক পেশার প্রতিষ্ঠিত ও নন্দিত মানুষদের মধ্যে অবসর উত্তর একটি ডিপ্রেশন দেখা দেয়। যেমন একজন সচিব যিনি চেয়ারে থাকা অবস্থায় অনেক কিছুই করতে পারেন, অনেক মানুষ সত্য বা মিথ্যা মিশিয়ে তাকে প্রচুর প্রশংসা করে থাকেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর অনেকে তার ফোনই রিসিভ করেন না। একই ঘটনা ঘটে অনেক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তার সাথেও। তারা এ নিয়ে বেশ আক্ষেপ ঝাড়েন সুযোগ পেলেই। কিন্তু বাস্তবতা এটাই । এই সমাজ এখন কাজের সমাজ। কাজের কারণে আপনার টেবিলের সামনে বসে অনেক কথা বলবে তারা, অনেক সময় নষ্ট করবে, তৈলমর্দন করবে। আপনি যখন আর কাজের নন, তখন আপনার গুরুত্ব কমবেই। এ নিয়ে আক্ষেপ দেখালে, ইগো দেখালে বা অন্যকে দোষারোপ করলে পদ্ধতিতে কোন পরিবর্তন আসবে না। এই সমাজ আমরাই তৈরী করেছি। পরিবর্তন আমাদেরকেই করতে হবে। আমরা আমাদের জীবনে যতটুকু আছে ততটুকু নিয়েই খুশি থাকবো। যা হারিয়েছে, তাতো চিরকালের জন্য এসেছিল না।

সুশান্ত সিং এর মৃত্যু রহস্য নিয়ে তদন্ত হোক এটা আমি চাই, তার চেয়ে বেশি চাই এটি নিয়ে গবেষণা হোক। কেন মানুষকে আলো দেখানো মানুষগুলো হারিয়ে যাবে অন্ধকারে? তাহলে কি সমাজ মেনেই নেবে আত্মহত্যা করার পর্যাপ্ত কারণ থাকলে আত্মহত্যা করা যায়? এই পর্যাপ্ত শব্দটিকে কোন স্কেল দিয়ে মাপবেন? জেএসসি পরীক্ষায় একটু নম্বর কম পাওয়া বা কিশোর প্রেম ব্যর্থ হওয়ার মত কারণগুলো কি যথেষ্ট? আত্মহত্যা যেখানেই ঘটুক আর যে কারণেই ঘটুক তা সমাজে একটি বিপজ্জনক মূল্যবোধ তৈরী করতে সাহায্য করে। দু:খিত হই, ব্যথিত হই ও আতঙ্কিত হই যখন মানুষের মন জয় করা মানুষগুলো পরাজিত হয় নিজের সাথে। তারা জানে না তাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে তারা হয়তো বন্ধুহীন হয়ে পড়ছিল, হয়তো তাদের অনেকেই কাছে টেনে নিচ্ছিল না; তবে পৃথিবীর কত মানুষ তাদেরকে ভালোবাসে। সেই সব ভক্ত মানুষদের দিকে কি তাহলে তারাকারা ফিরেও চান না? তাকিয়েও দেখেন না একবার? আপনি যদি তারকা হন, যদি আপনি একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হন আপনিও কি এই কাজ করছেন? তাহলে জেনে নিন, আকাশের তারাও একদিন নিভে যায়। আজীবন জ্বলার জন্য তারকা হবেন না। এর পরিণতি ভালো নয়। সুশান্ত সিং এর মৃত্যু নিয়ে তদন্ত হোক, হোক গবেষণা। আমরা বের হতে চাই আত্মহত্যার মতো ঘটনার বেড়াজাল থেকে।


সহস্র  সুুমন
লেখক ও কবি
পাবলিক পলিসি গবেষক,
ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার, যুক্তরাজ্য