স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি ও বঙ্গবন্ধুর "বাকশাল"


Dhaka | Published: 2020-08-07 00:56:30 BdST | Updated: 2024-06-26 17:01:32 BdST

|| ফুয়াদ হাসান ||

১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলঃ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল।

স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য বাকশালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন পিতা মুজিব। বাকশাল গঠন করা হয়েছিল দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ভেতরে থাকা বৈষম্যে দূর করে সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসা। মূলত বঙ্গবন্ধু সকল মানুষকে নিয়ে একটি জাতীয় দল গঠন করে বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক তথা দুঃখী মেহনতি এবং শোষিত মানুষের সার্বিক মুক্তির পথকে তরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। একে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বা ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাকশালের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদী শোষকদের প্রতারণামূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং শোষনের অবসান ঘটিয়ে শোষনহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কেন প্রয়োজন হয়েছিল বাকশালের? তা গবেষণার দাবি রাখে। আরও গবেষণার দাবি রাখে এর মাধ্যমে সত্যি কি শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো কিনা? এসব কিছুর উত্তর পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা জরুরী।

আমাদের আরও জানতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ কারা ছিল এবং স্বাধীনতার পরে তাদের ভূমিকায় বা কী ছিল? সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে রাষ্ট্র বিরোধী কি এবং কোন কার্যক্রমে লিপ্ত ছিলো তারা?? বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্র ছিলো কারা? স্বাধীনতার পরে তাদের ভূমিকা কী ছিলো?? দেশের কোন ব্যক্তিবর্গ জনগণের কথা ভাবতো এবং কারা নিজের স্বার্থ হাসিলের চিন্তা করতো? তা জানাটাও জরুরী বলেই মনে করি।

বাংলাদেশের প্রথম সরকার কী কী বাধার সম্মুখীন হয়েছিল সদ্যোজাত বাংলাদেশে? তাদের কী কী কাজ করার ছিল, সরকার কতটুকু করতে পেরেছিল? সরকারের কী কী কর্মসূচি ছিল? এই বিষয়গুলিও আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু এবং বাকশাল কর্মসূচির বিষয় জানার পূর্বে বাকশাল কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে গঠন করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর এই অভিজ্ঞতা কতটা বাস্তবসঙ্গত ছিলো?এই দর্শন কতটা যুক্তিযুক্ত এবং এই সিদ্ধান্ত কতটা মঙ্গলজনক ছিল তার একটা অনুসিদ্ধান্তে আসা জরুরী। শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে বঙ্গবন্ধু অথবা জাতির পিতা'ই পরিনত বা আখ্যায়িত হয়নি।

শেখ মুজিব যখন টুঙ্গিপাড়ায় এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন থেকেই তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র সতেরো বছর। অবশ্য তার আগে ১৯৩৬ সালে তাঁর চোখ অপারেশনের কারণে লেখাপড়া বন্ধ ছিল কিছুদিন। সে সময় তিনি স্বদেশীদের সভায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন; এ জন্য গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরে যাওয়াআসা করতেন তিনি নিয়মিতভাবে। সে সময়ই তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত হন এবং চিন্তা করেন দেশে স্বাধীনতা আনতে হবে। এরপর ১৯৩৭ সালে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি গোপালগঞ্জে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। বাড়ি বাড়ি থেকে মুষ্ঠি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে সেই চাল বিক্রি করে অসচ্ছল ছেলেদের বইপত্র এবং পরীক্ষার খরচ সহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করা ছিলো এই সমিতির কাজ। এই সমিতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করতেন কিশোর বঙ্গবন্ধু। এরপর যক্ষ্মা রোগে শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ মারা গেলে বঙ্গবন্ধুই এই সমিতির সম্পাদক হন; এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ।

তারপর ১৯৩৮ সাল থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৩৯ সালে গঠিত হয় মুসলিমলীগ। এই সময় থেকে থেকে দেশ এবং দেশের সাধারণ মানুষ চিন্তা ছাড়া আর কিছু ভাবেননি বঙ্গবন্ধু।

তাদের বাড়িতে পত্রিকা রাখা হতো, তিনি নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। শেরে বাংলা এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন সেই ১৯৩৮ সাল থেকেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বিভিন্ন সভাসমাবেশে বক্তৃতা করে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।

এরপর আবার আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন দেখলেন, বাঙালিদের অধিকার হরণ হচ্ছে, তখন শুরু করেছিলেন আবার সংগ্রাম-আন্দোলন। এভাবে ১৯৩৭-১৯৭৫ দীর্ঘ ৩৮টি বছর সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তার নিজেস্ব দর্শনে স্থির হতে সাহায্য করেছিল।

তিনি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে, জনগণই হবে প্রজাতন্ত্রের মালিক। তাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল হলো বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রতি ভালোবাসা। এছাড়া বিশ্ব রাজনীতিও তাঁর দর্শনের সহায়ক হয়েছিল। যেমন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের স্নায়ুযুদ্ধ, বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক চীন বিপ্লব, চীনের অগ্রযাত্রা, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে ব্যাপক প্রভাব রাখে। বিশ্ব পরিস্থিতি এবং দেশের অবস্থা
দুই অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে তিনি বাংলাদেশের জনগনের উন্নয়নের জন্য নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত অস্থিতিশীল এবং বিশৃঙ্খল ছিল। এই সংবেদনশীল পরিস্থিতির একমাত্র কারণ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপতৎপরতা।

১৯৭১ সালে ভারতে বসে খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধ বানচালের চেষ্টা করেছিল। এমনকি পাকিস্তানীদের সাথে আতাত করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছিল। কিন্তু তার এ চক্রান্ত ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের কাছে ধরা পড়ে যায়, তাই সে সময় মোশতাক কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেনি। কিন্তু সে থেমেও থাকেনি। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার ইচ্ছা তাকে প্রতিনিয়ত প্ররোচিত করতো। তাই বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একের পর এক গুটি চালতো।

প্রথমেই সে যা করেছিল তা হলো, বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর সবার আগে গিয়ে দেখা করে নিজেকে বিশ্বাসী প্রমাণ করা। এবং তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে কথা বলে তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ভেঙে দেয়া। কারণ সে জানতো তাজউদ্দীন এবং বঙ্গবন্ধু একসাথে থাকলে নিজের স্বার্থ হাসিলের কোনো উপায় থাকবে না। এভাবে সে মন্ত্রিপরিষদে স্থায়ী হয়েছিল। এখান থেকেই চলছিল তার কুকর্ম। খুব সতর্কতার সাথে সে বিভিন্ন কাজ করছিল। শুরু করেছিল আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার, ভারতবিরোধীতা এবং দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য সংকট তৈরির কাজ। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল দেশি এবং আন্তর্জাতিক বাংলাদেশবিরোধীদের তৎপরতা। স্বাধীনতার পর এরা বঙ্গবন্ধুকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়নি।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মার্কিন দূতাবাসের দূত হন বুষ্টার। দায়িত্ব নেওয়ার পরের পরদিনই খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করেন বুষ্টার। মোস্তাক এবং বুষ্টারের যৌথ কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল মূলত তখন থেকেই। অন্যদিকে চীনাপন্থি বাম সংগঠন এবং নকশালরাও শুরু করে খুন ধর্ষণ ও লুটপাট। এরা সাধারণ মানুষদের হয়রানি করা শুরু করেছিল।

আবার ছাত্রলীগও দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েও আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশে বঙ্গবন্ধুকে একটি বছর সময় দেয়নি বিরোধীরা, এমনকি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তাঁরাও! তারা হয়তো ভেবেছিলেন স্বাধীনতার সাথে সাথে বাংলাদেশ স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে। তাঁদের একবারও মনে হয়নি দেশটা পুরোপুরিভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত, কোনো কিছুই দেশে অবশিষ্ট নেই; একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।

বিজ্ঞ এবং প্রাজ্ঞরা গোপনে বঙ্গবন্ধু বিরোধী মনোভাব পোষন করতেন। তাদের জ্ঞানগরিমা দেশ গঠনের কাজে লাগালে দেশের উপকার হতো কিন্তু তারা শুরু করেছিলেন মুজিববিরোধী কর্মকান্ড। তাদের সমস্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা মুজিব বিরোধীতায় কাজে লাগান তারা, এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ।

১৯৭২ সালের অক্টোবরে ভারত থেকে দেশে ফিরে মওলানা ভাসানী শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধীতা। ১৯৭২ সালে ১৭ সেপ্টম্বর আ.স.ম. আব্দুর রব সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ভাষণ দেন।

সিরাজ শিকদার নিজের সর্বহারা পার্টি নিয়ে অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছিলেন। কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুর কাজের সবটুকু বিশ্লেষণ না করেই সমালোচনা এবং বিরোধীতা শুরু করেছিলেন।১৯৭২ সালের শেষ প্রান্তে ঢাকা শহর ছেয়ে গেল বঙ্গবন্ধু-সরকারবিরোধী পোস্টারে।

সব মিলিয়ে ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধুর জন্য বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ছিল প্রকাশ্যে বিরোধীতা। অন্য দিকে আরেকটি দল ভালো মানুষের মুখোশ পরে দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ রাখছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য। এতে পাকিস্তান আমেরিকা চীন মদদ যুগাচ্ছিলো।
এই দল ছিল আগের দলের চেয়েও ভয়াবহ ;
এই শত্রুরা মিত্র সেজে ঘুরছিল বঙ্গবন্ধুর চারপাশে।

বাঙালি যে শত্রু হতে পারে বঙ্গবন্ধু ধারণাই করতে পারেননি। তিনি মনে করেছিলেন, এ সব বিরোধিতা সাময়িক ব্যাপার। তিনি এও চিন্তা করেছিলেন যে এ অবস্থা তিনি রুখবেন। কারণ সাধারণ জনগণ তাঁর পক্ষে ছিল। কিছু বিপথগামী মানুষ হইচই করে তাঁর গতি রোধ করতে পারবে না। তাই এই বৈরি পরিবেশেই বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়ণ হয়েছিল। সংবিধানের মূলনীতি ছিল- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। মওলানা ভাসানী এই সংবিধানেরও বিরোধীতা করেছিলেন।

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাসদ দেশ অস্থির করে তুলেছিল। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ির সামনে বোমা ফাটিয়েছিল এবং বাড়ির গেটে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের কোন্দলেই ৭ জন ছাত্রলীগ কর্মী প্রাণ হারান। এ কারণে শফিউল আলম প্রধান পল্টন ময়দানে সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতাদের বিরুদ্ধে জনসভা করেন। ১৪ এপ্রিল ভাসানীর ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ( লেলিনবাদী), শ্রমিক-কৃষক সাম্যবাদী দল মুজিব সরকার উৎখাতের ঘোষণা দেয়।

প্রচলিত গণতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধু এগুলো সহ্য করে যাচ্ছিলেন এবং এ থেকে দেশকে বাঁচানোর উপায় খুঁজছিলেন। উপায় খুঁজছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্থান-পতন এবং নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞার আলোকে। তাঁর একমাত্র চিন্তাই ছিল দীনহীন মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু স্বাধীন দেশের পরিবেশ এতাটাই শত্রুভাবাপন্ন হয়ে গিয়েছিল যে তিনি কঠোর হাতে তা দমনের চিন্তা করছিলেন।

এ সময় প্রকৃতিও বৈরি হয়। বন্যায় সারা দেশ তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয় অসংখ্য মানুষের বসতবাড়ি।  প্রাণ হারায় লক্ষাধীক মানুষ। মারা যায় লক্ষ লক্ষ গবাদিপশু, বিনষ্ট হয় জমির ফসল। অতিরিক্ত বন্যায় সড়ক এবং ট্রেন যোগাযোগ হয়েছিল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর।বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সাহায্য চেয়েও পাননি। মজুদদাররা প্রয়োজনীয় খাদ্য বাজারে ছাড়ল না। এই সুযোগে মোশতাকসহ সমস্ত বিরোধীপক্ষ বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধীতা শুরু করেছিল এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেছিল গোপনে।

এই অবস্থা সামাল দিতে তিনি বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। যেন অবাধ্য সন্তানকে কঠোর হাতে দমন করে ভালো পথে আনার কৌশল। তিনি বাকশালের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হতে চেয়েছিলেন। বাকশাল গঠন উপলক্ষ্যে তিনি জাতীয় সংসদে যে ভাষণ দেন, তাতে তাঁর লক্ষ্য সম্পূর্ণ বোঝা যায়। জাতীয় সংসদে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন:

‘একটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমরা স্বাধীনতা পেলাম এবং রক্তের বিনিময়ে পেলাম সাড়ে সাত কোটি লোক, ৫৪ হাজার স্কোয়ার মাইল। সম্পদ বলতে কোনো পদার্থ আমাদের ছিল না। সমস্ত কিছু ধ্বংস। ... অর্থনৈতিক কাঠামো নেই। একটা ফরেন অফিস নেই, একটা প্ল্যানিং অফিস নেই। নেই একটা কোনো কিছু। এই সুযোগে, যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, নিজেদের একটা বেস করা যায় কিনা, ভবিষ্যতে তাদের স্টুজরা এদেশে সরকার চালাতে পারে কিনা, তার ফিকির খুঁজতে লাগল। কাজ করব না, ফাঁকি দেব। অফিসে যাব না ফাঁকি দেব, ফ্রিস্টাইল। দেশের শত্রুরা এনজয়েইং ফুল লিবার্টি বিদেশিরা আসেন এখানে, তাদের গোপনে দু’বোতল মদ খাইয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্রিফ করে দেয়। আমরা কিন্তু চেষ্টা করলাম। ঠিক আছে, আচ্ছা বল, আচ্ছা কর। আচ্ছা দল গড়, আচ্ছা লেখ, আচ্ছা বক্তৃতা কর, বাধা নেই। ফ্রি-হ্যান্ড। কিন্তু দেখতে পেলাম কী? আমরা যখন এই পন্থায় (প্রচলিত গণতান্ত্রিক পন্থায়) এগোতে শুরু করলাম, বিদেশি চক্র এদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তারা এ দেশের স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করল এবং ফ্রিস্টাইল শুরু হয়ে গেল। হুড়হুড় করে বাংলাদেশে অর্থ আসতে আরম্ভ করল। দেশের মধ্যে শুরু হল ধ্বংস, একটা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। মোট কয়েক হাজার কর্মীকে হত্যা করা হল। যারা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিবাহিনীর ছেলে, তাদেরকে হত্যা করা হল। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উদার গণতন্ত্রের সুযোগে রাজনীতির নামে হাইজ্যক ডাকাতি, টেলিফোন করে মানুষের কাছ থেকে পয়সা আদায় করে বা মানুষের বাড়িতে গিয়ে গহনা কেড়ে নেয়।

রাজনীতির নামে অপরাজনীতির পসরা শুরু হয়ে গেল। তাই এ রাজনীতি আমি চাই না, এ গণতন্ত্র আমার মানুষ চায় না।

এমেন্ডমেন্ড কনস্টিটিউশনে যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি তা-ও গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে।বহুদিন কারাগারে একলা একলা চিন্তা করেছি, আমার দেশের শতকরা ২০ জন লোক শিক্ষিত, তার মধ্যে এক গ্রুপ পলিটিশিয়ান হয়ে গেলাম। এক গ্রুপ আমরা বুদ্ধিজীবী। এক গ্রুপ টিচার। এক গ্রুপ সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ী হয়ে গেলাম। কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম। কেউ অমুক হয়ে গেলাম। আমার সমাজে যত জ্ঞানী-গুণী লোক আছে এবং অন্য ধরনের, তাদের নিয়ে জাতীয় পুল করা দরকার। এই পুল আমি করতে পারি যদি আমি একটা নতুন সিস্টেম চালু করতে পারি এবং নতুন দল, সৃষ্টি করি জাতীয় দল, যার মধ্যে একমাত্র একপথ একভাবে হয়ে দেশকে ভালোবাসা যায়। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে তারা এসে একতাবদ্ধ হয়ে দেশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করে যেতে পারে, এ জন্যই বাকশাল করা হয়েছে।

এখানে স্পষ্টভাবে বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট এবং উদ্দেশ্য বোঝা যায়। বাকশাল গঠন করে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় কাঠামো একেবারে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় গ্রামকেই প্রশাসনিক ও উৎপাদন ইউনিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা চালু হলে সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতো। আমলাভিত্তিক প্রশাসনের অবসান চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আবীর আহাদ নিজের মতামতসহ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে:

‘বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, জনগণের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার স্বাভাবিক কারণে আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনের ফন্দিফিকির সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে, দুখী মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নতুন করে প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাসে উদ্যোগী হলেন। বললেন : ‘... সেকশন অফিসার, তারপর ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, এডিশনাল সেক্রেটারি, সেক্রেটারি, মন্ত্রী হয়ে তারপর আসে আমার কাছে। এ সবের কোনও প্রয়োজন নেই। সোজাসুজি কাম চালান।

ইডেন বিল্ডিং (সেক্রেটারিয়েট) বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে, থানায়, জেলা পর্যায়ে এটা পৌঁছে দিতে চাই, যাতে জনগণ সরাসরি তাদের সুযোগ-সুবিধা পায়।

মূলত রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণকে সরাসরি সুবিধা দেয়াই ছিলো বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দকে ‘বিনিয়োগ’ নামে অভিহিত করেছিলেন। সমবায় গঠন করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। চারটি মূলনীতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের দীন দুখী শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মেহনতি মানবগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার এবং তাদের সমষ্টিগত প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক’ শাসন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। আরও উল্লেখ করেছেন- প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে সমাজের মাত্র ৫৫ ভাগ লোকের বা প্রভাবশালী ধণিকশ্রেণির স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শোষণকার্য পরিচালনার পথই প্রশস্ত হচ্ছে; প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতরে কোনো বিরোধ নেই; সমাজের বাস্তব অবস্থাই মানুষের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। সংবিধানের তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি’ কথাটি রয়েছে। সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে সমষ্টিগত মানবগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার চিন্তা তিনি করেছিলেন। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে এক পরিবারভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া প্রশাসনকেও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেনাবাহিনীকে দেশের দৈনন্দিন কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারের শেষ ভাগে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেনঃ

‘আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি; জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে আমাকে নিবৃত করা যাবে না।  আমার কাজ আমি করে যাবই।হয়তো শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরোয়া করি না।

আমি যা বলি, তা-ই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম, এদেরকে মুক্ত করে ছাড়ব, মুক্ত করেছি। বলেছি, শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত বাংলা গড়ব, তা-ই করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ্‌। কোনো কিন্তু-টিন্তু নেই, কোনো আপোস নেই।৫

এই সাক্ষাৎকারেই তিনি বলেছিলেন তিনি যদি নাও থাকেন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস বাঙালিরা যে কোনো মূল্যে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়ন করে ছাড়বেন। এতে প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ দ্বিধাহীনভাবে বাঙালির উপর আস্থা এবং বিশ্বাস রেখেছিলেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দেশ গঠনের পরিবর্তে কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলের চিন্তা করেছিল। তারা এ কারণে তৈরি করেছিল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। একটি ঘটনা জন্ম দিতো আরেকটি ঘটনার। বঙ্গবন্ধু সব দেখতেন, কিন্তু তাদের গণতান্ত্রিকভাবে মত প্রকাশ করতে দিতেন। এই অবস্থা বাড়তে বাড়তে দেশ এক অরাজক পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছিল। দেশকে সঠিক পথে আনবার জন্য তাই তিনি রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। জীবনের শুরু থেকে সমস্ত জীবন তিনি দেশের মানুষের মুক্তির চিন্তা করে গেছেন। তাই তিনি সব মানুষের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন। কিন্তু কাজ শুরু করতে পারেননি। বাকশাল গঠন হওয়ার পর ধনী এবং প্রভাবশালী মহলও শত্রুতা শুরু করে। তারা মনে করে, তাদের হাত থেকে সম্পদ চলে যাবে কৃষক-শ্রমিকের হাতে। আবার প্রশাসনের আমলারাও চিন্তা করে তাদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাবে জনপ্রতিনিধিদের কাছে; কিংবা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একইভাবে সামরিক বাহিনীতেও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই সমস্ত সুবিধাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং পুঁজিবাদীদের সম্মিলিত চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভে যায় এবং নিভে যায় বাঙালি জাতির সত্তাপ্রদীপ। তবে বাকশালের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি, বাকশালের সমস্ত ধারা বাস্তবায়ন হলে এতো দিনে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হতো।

লেখক: ফুয়াদ হাসান। আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক- বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

মতামত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে ক্যাম্পাস টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। ক্যাম্পাস টাইমস সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় ক্যাম্পাস টাইমসের নয়।