অনলাইন শিক্ষা নীতিমালায় শিক্ষার্থীর অগ্রাধিকার


Dhaka | Published: 2020-08-12 19:10:05 BdST | Updated: 2024-06-26 17:10:49 BdST

|| ড. সাদেকা হালিম ||

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী সকল বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখেছি অন্তত ত্রিশ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ইন্টারনেট অভিগম্যতা। ১৮ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে হলও বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন গ্রামে অবস্থান করছে। সেখানে অনলাইন ক্লাসের জন্য অনেককে গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে কিংবা দূরবর্তী কোথাও গিয়ে ইন্টারনেট পেতে হচ্ছে। নেটওয়ার্ক সমস্যা, ইন্টারনেটে ধীরগতি, লোডশেডিং, ডিভাইসের অভাব থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে তাদের আগ্রহ অনিশেষ।

চলমান অতিমারিতে অনেকেই আর্থিক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও সমস্যায় রয়েছে। তারপরও তারা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, নিজেদের বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারছে; সেটিও এর একটি ইতিবাচক দিক বটে।

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সমস্যাসহ সার্বিক দিক নিয়ে আমরা একটি নীতিমালা তৈরি করছি। ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে চালাতে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইউজিসি। এ জন্য ইউজিসি যেসব শিক্ষার্থীর ডিভাইস কিনতে আর্থিক সক্ষমতা নেই, শুধু সেসব শিক্ষার্থীর নির্ভুল তালিকা ২৫ আগস্টের মধ্যে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করেছে ইউজিসি। অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য অনেকের ডিভাইস নেই এ জন্য ইউজিসির এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।

আমি মনে করি, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি সবার আগে দেখা উচিত। সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এর বিকল্পও নেই। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি নবীন শিক্ষকদেরও সমস্যা থাকতে পারে। তারা যেন শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষাসেবা দিতে পারে সেজন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট ও ভালো মানের ল্যাপটপসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া দরকার।

শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সমস্যার সমাধানে মোবাইল সেবা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে। তারা যেন শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমই কেবল পরিচালনা করা যাবে। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পারবে না। মোবাইল কোম্পানিগুলো এগিয়ে এলে যেসব শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই তাদের সমস্যার সমাধান করাও সম্ভব হবে।

অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের ডিভাইস সমস্যা সমধানেও সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে পারে। ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন কিনতে ব্যাংকগুলো বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। ল্যাপটপ-স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোও সহজ ও সুদমুক্ত কিস্তিতে শিক্ষার্থীদের এসব ডিভাইস সরবরাহে এগিয়ে আসতে পারে। ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া যদিও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে কিন্তু মনে রাখা দরকার অনেকেরই ব্যাংক কার্ড নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর শিক্ষক/বিভাগের পরামর্শকের রেফারেন্স গ্রহণ করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধান করে আমাদের এমন একটি অনলাইন শিক্ষা নীতিমালা করতে হবে, যার মাধ্যমে একটি কার্যকর ও ফলপ্রসূ শিখন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। উন্নত বিশ্বে ভার্চুয়াল বা অনলাইন শিক্ষা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। করোনা মহামারির কারণে সেটি আরও ভালোভাবে সামনে এসেছে। বিশ্বের স্বনামধন্য উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে পুরোপুরি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের সব ক্লাস অনলাইনে হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। কেমব্রিজসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘোষণার খবরও আমরা পেয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমরাও পুরোদমে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারলে কেবল ভার্চুয়ালি আমাদের সক্ষমতাই প্রমাণ হবে না। একইসঙ্গে প্রয়োজন সাপেক্ষে আমরা বিশ্বের স্বনামধন্য শিক্ষকদেরও কানেক্ট করতে পারব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও গবেষণার মানোন্নয়নের জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে যোগাযোগ স্থাপন প্রয়োজন সে চাহিদাও এর মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হবে। বিদেশের কোনো স্বনামধন্য শিক্ষককে গেস্ট স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো, এক্সচেঞ্জ কার্যক্রম পরিচালনা ও সহযোগী গবেষকের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। এজন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেটভত্তিক নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম দরকার। এমনভাবে এক্সক্লুসিভ সফটওয়্যার তৈরি করতে হবে, যাতে সমস্যা ছাড়াই সকল শিক্ষক সুন্দরভাবে শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের জন্যও সেটা সহজ হয়।

কেবল অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্যই নয়, এমনিতেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত একটি ডিজিটাল আইডি থাকা উচিত। আমি যখন কমনওয়েলথ স্কলার হিসেবে কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে যাই, সেখানে মাস্টার্সে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে আইডি দেওয়া হয়, ই-মেইল অ্যাড্রেস দেওয়া হয়। সেই আইডি ও ই-মেইল ঠিকানা দিয়েই আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ' বছর উপলক্ষে আমি চাই সকল শিক্ষার্থীর ডিজিটাল আইডি হোক।

ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডিজিটাল আইডি ও ই-মেইল দিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীর ফল, লাইব্রেরি একসেস, হেলথ ইন্স্যুরেন্স সবই সে আইডির মাধ্যমে হতে পারে। ভার্চুয়াল আইডির পাশাপাশি শিক্ষার্থীর আইডি কার্ডও এমনভাবে তৈরি করা দরকার যেটি সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। এখন যেমন জাতীয় জীবনে ন্যাশনাল আইডি সকল কাজে লাগছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডও এমনি হওয়া উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, অন্তত শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আইডির মাধ্যমে সেটা আমরা বাস্তবেও দেখাতে পারি।

তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে আমরা দেখেছি করোনাভাইরাসের মধ্যেও মানুষের জীবন থেমে থাকেনি। প্রযুক্তির কল্যাণে বাসায় থেকেই মানুষ অফিস করছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাসায় থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সেমিনার, কর্মশালায় আমরা অংশগ্রহণ করেছি। বাস্তবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়া হয়েছে। এ সময় শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ থাকেনি। রেডিও, টিভি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার কাজ চালিয়ে নিয়েছে। করোনা দুর্যোগের মধ্যেও আমরা আম্পান এবং এরপর বন্যার সম্মুখীন হয়েছি।

এরমধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তথা সকলের আন্তরিকতায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো আমি শুরুতে আলোকপাত করেছি সকলের প্রচেষ্টায় তা দূর করাও খুব কঠিন হবে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাস উপভোগ করছে। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন না থাকার কারণে যারা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ব্যাপারে ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগ সুফল বয়ে আনবে বলেই আমার বিশ্বাস। ইন্টারনেটের গতি বাড়িয়ে ও স্বল্পমূল্যে বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করে মোবাইল কোম্পানিও শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াক।

ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

লেখাটি জাতীয় দৈনিক সমকাল থেকে নেয়া