বিশ্ববিদ্যালয়: বহতা নদী হোক, বদ্ধ পুকুর নয়


Dhaka Tribune | Published: 2020-08-20 18:39:18 BdST | Updated: 2024-09-29 04:49:48 BdST

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ স্বেচ্ছায় ক্ষমতার পদতলে আত্মবলি দিচ্ছে। দুঃখজনকভাবে বিষয়টি শুরু হয়েছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। মাছের পচন নাকি মাথা থেকে শুরু হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থারও সেটাই হয়েছে কিনা, তা গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মুক্তকথা, মুক্তচিন্তার সুযোগ না থাকে তাহলে তা ক্রমাগত কুপমুণ্ডক তৈরি করে যাবে। দুঃখজনক হচ্ছে এই যাত্রায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণিবাত্যার মতো ক্রমশ বেড়ে চলা এ প্রক্রিয়াটিকে আমি বলতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর "প্রাতিষ্ঠানিক কুপমুণ্ডকীকরণ"।

সম্প্রতি বিষয়টা নতুন করে সামনে এসেছে। কারণ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাদেরকে বহিষ্কার করেছে। তাদের অপরাধ-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সরকারের বা সরকার দলীয় রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছেন। যদিও এ কাজের জন্য তাদের ওপর সরকারের বা রাজনৈতিক দলের কোনো প্রত্যক্ষ চাপ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং তারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে এই কাজগুলো করে যাচ্ছে। যে সমালোচনাটা কেউ হয়তো ধর্তব্যই মনে করতো না, হয়তো কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর ভিতরেই ঘুরপাক খেয়ে স্তিমিত হয়ে যেতো, সেটাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর এই অতিমাত্রায় রাজনীতিপ্রীতি।

বাধ্য হয়ে সরকারদলীয় একজন তরুণ নেতা তার ফেসবুকে লিখেছেন, এই অতি উৎসাহ দেখাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বরং সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতি করছে। তিনি বলেছেন, কারো যদি সম্মানহানির ব্যাপার ঘটে অন্তত তাকে মামলা করতে দেওয়া হোক। তারপর না হয় কোন একটা ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।

এখনও কোনো মন্ত্রী, এম.পি’কে দেখিনি নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তাদের মানহানির জন্য মন্তব্য করেছেন বা মামলা করেছেন। কারণ, এতটুকু সহ্যশক্তি নিয়েই তারা রাজনীতির মাঠে এসেছেন। তারা জানেন, কেউ কেউ তাদের গালি দেবে, আবার কেউ তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হয়েছে “মায়ের চেয়ে মাসির দরদ” উপচে পড়া অবস্থা। তারা তিলমাত্র অপেক্ষা করতে রাজি নয়। নিজেদের শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার পরিবর্তে তারা একলাফে থানা পুলিশে গিয়ে উপনীত হচ্ছে।

একজন শিক্ষার্থীর কোনো মন্তব্য যদি সীমা ছাড়িয়ে যায় তাহলে তাকে সতর্ক করা যেতে পারে। কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই কণ্ঠরোধের চেষ্টা অনুচিত। বরং শিক্ষার্থীর স্বাধীন মত সে প্রকাশ করুক। তারপর কারো বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ থাকলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিই অভিযোগ দায়ের করুক। বাংলাদেশের যে কোনো রাজনীতিবিদ কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা পান। অল্প কিছু লোক তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতেই পারে। তাদেরকে পাওয়ামাত্রই জেলে পুরতে হবে এই ধারণাটা হঠাৎ করে সবাইকে পেয়ে বসলো কেন? আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই ধারণায় এতোটা বুদ হয়ে গেলো কিসের নেশায়? আমরা তো উত্তর কোরিয়া নই। আমাদের নেতৃবৃন্দ এখনো জনসভায় যান। এখনো নিজের জীবন বাজি রেখে জনসাধারণের মাঝে কাজ করেন। তাদের ভয় কিসের? আমরা তো কাগজে কলমে এখনো গণতান্ত্রিক দেশ। মুক্তমতের গলায় তবে কেন এই ছুরি চালানোর প্রতিযোগিতা?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাগুলো এমনিতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর জায়গা। গ্রাম বা মফঃস্বল অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলগুলোতে রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের কেউ কেউ সারাজীবন সেই নির্যাতনের চিহ্ন শরীরে ও মনে বয়ে বেড়ায়। শরীরের ক্ষত শুকালেও মনের ভাঙন আর জোড়া লাগে না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেননি। উলটে তারা রাজনৈতিক শক্তির কাছে নমনীয়ই থেকে গেছেন। আমরা যখন বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নিজেদের তুলনা করি, আন্তর্জাতিক তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দেখতে চাই, তখন এই ভয়াবহ চিত্রটির কথা ভুলে যাই। আমরা মনে করি, সবকিছু এখানে ঠিকঠাক চলছে, পড়াশোনা ও গবেষণায় সোনা ফলছে না কেন?

বাস্তবতা হচ্ছে আমরা কখনোই কোনো তালিকায় স্থান পাবো না যতদিন না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান চর্চাকে প্রাধান্য দিতে পারবো। সরকারের সাথে, উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে আমাদের সমন্বয় ও আলোচনা দরকার গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে। আমাদের পরিবর্তন দরকার এসব জায়গায়। ভীতিহীন, শিক্ষা বান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য কাজ করা দরকার আমাদের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের যাত্রা ঠিক তার বিপরীতে। এতোদিন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠনগুলোর ভয় ছিলো, এখন শিক্ষক আর প্রশাসনের ভয়টাও যুক্ত হলো। এতদিন প্রক্টর, প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে যেতেন, উপাচার্যগণ ফোন দিতেন; এখন তারাই অভিযোগ দায়ের করে শিক্ষার্থীদের থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। আমরা অবনতির দিকেই চলছি।

দেশের অগ্রগতির স্বার্থে এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের “চেক-এন্ড ব্যালান্স” নিশ্চিত করার জন্য সমালোচনার সুযোগ থাকা দরকার। স্বাধীন মতামত প্রকাশ হচ্ছে একটি চলমান নদীর মতো। এ নদী উর্বর। এখানে নানান প্রাণের সৃষ্টি হয়, উচ্ছ্বল স্রোত বয়ে যায় । আর সমালোচনাহীন, ভীতিকর পরিবেশ হচ্ছে একটি বদ্ধ পুকুর। এখানে প্রাণ থাকলেও তার বিকাশ নেই, ক্রমাগত জমে ওঠা আবর্জনায় এ পুকুর অনুর্বর, এখানে বড়জোর কিছু কূপমুণ্ডুক বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বৃহৎ সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চার পথ বন্ধ করে দিয়ে কূপমুণ্ডুক তৈরির পথ প্রশস্ত করছে। এটা জাতির বিকাশের অন্তরায়।আ মরা হয়তো শ’য়ে শ’য়ে ডিগ্রিধারী দেখবো, কিন্তু তার সাথে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিকাশের কোনো যোগ থাকবে না।

কারো মতামতে বা লেখালেখিতে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা অনিরাপদ বোধ করে, তাহলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নেবে। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই যদি আইনের খড়গ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেই হাজির হয় নিজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দরজায় তাহলে ক্ষমতাবানদের প্রশস্তি ছাড়া কারো আর কিছু করার থাকবে না। গড্ডলিকা প্রবাহে অন্ধের মতো গা ভাসিয়ে আত্মাহীন, চিন্তাশক্তিহীন এক খোয়াড়ে জায়গা হবে সবার।

সরকার যদি আসলেই দেশের উন্নতি চায় তাহলে আশা করবো তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করবে। বাধ্য হয়েই সরকারের দ্বারস্থ হলাম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাশাসনিক পর্যায়ে স্বাধীন চিন্তার ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো তাই প্রমাণ করে।

ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়