ভারত না চীন, কোন পথে হাঁটবো আমরা?


মিরাজ আহমেদ | Published: 2020-09-20 04:17:30 BdST | Updated: 2024-09-29 04:50:06 BdST

যখন হাতিরা (ভারত-চীন) লড়াই করে ঘাস মারা পরে, হাতিরা যখন আবার প্রেম করে তখন ও ঘাস (খায়) মারা পরে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি হিসিয়েন এর এই বাণী কি আমাদের (বাংলাদেশের) জন্য ও সত্য প্রমাণিত হবে? যে যাই বলুক, সক্ষমতার প্রশ্নে ভারত এবং চীন উভয়ই বাংলাদেশের কাছে এখনো হাতি-সম। এদিকে আমেরিকা আবার নতন ”টোপ” দিচ্ছে। চিনের সাথে আমাদের কত গলাগলি সেটা পরিক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেবে। (খবর টাইমস অফ ইন্ডিয়া)

"সকল ছোট দেশগুলোকে একসময় অদৃশ্য হয়ে যেতে হবে"! ’১৯১৪ সালের আগস্টের শুরুতে প্রথম বিশযুদ্ধের সময় সদ্য-দখলকৃত বেলজিয়াম শহরের মেয়রের কাছে এই ছিল এক জার্মান কর্মকর্তার বার্তা। এই জাতীয় ধারণা তখনকার আমলে অস্বাভাবিক ছিল না। কলোনাইজেশন, দখলদারি এবং আক্রমণের কারণে গত শতাব্দীর শুরুতে এটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল যে কেবল বৃহত্তর দেশগুলোই বেঁচে থাকতে পারে; ছোটগুলোর ধ্বংস অনিবার্য। বিশিষ্ট জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রিডরিচ নওমান ১৯১৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রভাবশালী বই 'সেন্ট্রাল ইউরোপ' এ যুক্তি দিয়েছিলেন যে বিংশ শতাব্দীর প্রধান সমস্যাগুলি কেবল বড় বড় দেশগুলিকে সাথে নিয়েই মোকাবেলা করা যেতে পারে। আঞ্চলিক বড় দেশগুলির নেতৃত্বাধীন ছোট দেশগুলিকে একীভূত করে সেটা করতে হবে। ইতিহাস কিন্তু তাদেরকে ভুল প্রমাণ করে আশার বাণী শুনায়। ১৯৪৫ সালে পৃথিবীতে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল মাত্র ৭৪ টি, এখন ২০২০ সালে সেটা ১৯৫ এর মত। ছোটো দেশগুলো তো একিভূত হয়- ই নাই উল্টো বড়ো দেশগুলো ভেঙে ভেঙে ছোটো হয়ে গেছে। সেটার জন্য (একীভূত) অবশ্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন হলো ছোট দেশ কাকে বলা যায়? বলতে পারি আয়তন, কিংবা জনসংখ্যা অথবা অর্থনৈতিক সক্ষমতা। সিঙ্গাপুর, ইসরায়েল জনসংখ্যা কিংবা আয়তনে "ছোট" হলেও তাদের খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, আবার সুদান আয়তনে বড়ো হলেও সেই "ছোটো" ই রয়ে গেলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যানেট বেকার ফক্স বলেছিলেন ছোট দেশ বা 'ক্ষুদ্র শক্তি (small power) হলো ' স্থানীয় ' শক্তি যার চাহিদা তাদের নিজস্ব এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, আর পরাশক্তি হলো যারা ( super power) চেষ্টা করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে। তাহলে সামগ্রিকভাবে পৃথিবী কি ছোটো হচ্ছে না বড়? উত্তর দুটোই। অর্থনীতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবী যেমন বড়ো হচ্ছে আবার বিশ্বায়ন, চুক্তির ( ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন , নাফটা) কারণে ছোটো ও হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কি ছোটো না বড়?

বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রায় পাঁচ দশকের সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত ভারত ই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক অংশীদার। ২০১৫ সালের পর থেকেই পাশার দান উল্টে সেটা এখন চীনের সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ৩৫% জিনিস চীন থেকে আমদানি করে। এতে ভারতের ক্ষুব্ধ হবার কারণ অবশ্যই আছে। এদিকে ভারতের কিছু কার্যকলাপ নিয়ে ( সীমান্ত হত্যা, পেঁয়াজ রফতানি, পানি চুক্তি) বাংলাদেশি সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তার উপর বর্তমান বিজেপি সরকার তার দেশে মুসলিম নির্যাতন ও এদেশের মুসলমানদের মনে আঘাত দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

অপরদিকে চীনে উইঘুর মুসলমানদের উপর নির্যাতন, নিন্মমানের পণ্য সরবরাহ, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে চীনা আধিপত্য এবং কাজের মান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা, ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের চাপ সব কিছু মিলে চীনকে ও নিঃশর্ত বন্ধু ভাবতে পারছে না। এমনকি এখনো দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী করোনা র জন্য চীনকে দায়ী করে থাকে। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম এবং সেতেলাইট মিডিয়া সবকিছু পশ্চিমা এবং ভারতীয় নির্ভর হওয়ায় চীনের বিরুদ্ধে যেকোনো সংবাদ খুব ভালো বিকোয়। আবার ভারত বিরুদ্ধ কিছু হলেও জন সাধারণের মাঝে ক্ষোভ সঞ্চার হয়। সুতরাং, চীন না ভারত এই প্রশ্নে সাধারণ মানুষের মনে এই হাতি দুটিকে নিয়ে দুটানা লক্ষ্য করা যায়।

এক সময় ভারত- চীন সম্পর্ক খুব ভালো না হলেও এমনতো ছিলই না আবার বাংলাদেশ কে নিয়ে এত টানাটানি ও কম ছিল। টানাটানি এমন পর্যায়ে যে চীন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ (২৪ বিলিয়ন ডলার) আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা (যদিও এখনও বাস্তবায়ন হয় নাই) দেয়ার পর পরই ভারত বাংলাদেশকে সাহায্যের পরিমান বাড়াতে শুরু করে যদিও সেটা চীনের তুলনায় নগণ্য (৫ বিলিয়ন ডলার)। ভারত যেমন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা ( ফলাফল ২০১৯ সালে ভারতে রেকর্ড পরিমান ১ বিলিয়ন ডলার রফতানি) দিয়ে আসছিল, চীনের ক্ষেত্রেও গত ১ লা জুলাই থেকে ৯৭% শুল্কমুক্ত সুবিধা বিদ্যমান। করোনাকালিন সময়ে চিন যেমন নিজস্ব মেডিক্যাল টিম, মাস্ক, পি পি ই দিল, ভারতও নিজের অবস্থা খারাপ হওয়া সত্তেও কিছু চিকিৎসা সামগ্রী এদেশে প্রেরন করে। যে ভারত সীমান্ত নিয়ে নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, চীনের সাথে দশকের পর দশক অনড় সে ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশের ছিটমহল সহ প্রায় সকল সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে ফেললো!! মুদ্রার ওপিঠে হুমকি ধামকিও বিদ্যমান পাছে যদি বাংলাদেশ কথা না শুনে। ভারতের দিক থেকে NRC এর নাম করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি, রফতানি বন্ধ সহ মুসলিম নির্যাতনের করে পরোক্ষ হুমকিতে বোধহয় কিছুটা হলেও কাজ হয়েছে। আবার হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট গুলোতে চীনের প্রত্যক্ষ অবস্থানের কারনে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি তো আমাদের আছেই।

সরকার কোনো ভাবেই চাইবেনা চীন পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল সহ এইসকল অসমাপ্ত প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার কিংবা কাজের মান এবং গতি নিয়ে গড়িমসি করুক। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে চীনের নিজস্ব অর্থায়নে প্রস্তাবিত রেললাইন কুনমিং থেকে বার্মা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রকল্পটি মনে হয় আর আলোর মুখ দেখবে না। আবার দেশের অর্থনীতির জন্য খুব প্রয়োজনীয়, সোনাদিয়ায় চীনের নিজস্ব অর্থায়নে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর ভারতের আপত্তির কারণে বন্ধ হয়। সেই প্রস্তাবটি যদি জাপান, কোরিয়া কিংবা আমেরিকা, জার্মান দিত তখন ও কি ভারত আপত্তি করতো? উত্তর না হলে আমরা এখনো "ঘাস" ই রয়ে গেলাম।

বাংলাদেশ ও নিজের সক্ষমতা নিয়ে খুব আশাবাদী নয়ে। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যেমন দরকার দেশী - বিদেশি অর্থায়ন, আবার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ও খুব একটা উপায় নেই। তিন দিকেই ভারত বেষ্টিত ৪০৯৬ কিলোমিটার বর্ডার ভারতের সাথে (পৃথিবীতে ৫ ম)। আবার জলপথে ভারতীয় নৌ সেনাদের চোখ রাঙানি ত আছেই। চাইলেই ভারতকে ধুরে সরানো যাবে না কিংবা বাস্তবসম্মত নয়। আবার ঐদিকে বাংলাদেশের সামরিক খুঁটি নাটি সবই চীনের জানাশুনা। সামরিক সরঞ্জাম এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হলো চীনের ২য় বৃহত্তম ( পাকিস্থান ১ম) রফতানি বাজার। পাশাপাশি চীনের রোড এন্ড বেল্ট প্রোগ্রামের ( BCIM করিডোর) অন্যতম অংশীদার আমরা। চাইলেই চীনের সাথে সব সম্পর্ক নিমিষেই শেষ করা যাবে না। মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে করোনা উপস্থিত।

ঘাস কিংবা ছোটো যা-ই হই, তাহলে আমরা কোন পক্ষের? চীন, ভারত না নিরপেক্ষ? নাকি আমেরিকার টোপ গিলব? চিন, আমেরিকা অথবা ভারত যে পক্ষেরই হই না কেনো কোন না কোন সমস্যাতো ( সল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদি) আছেই। হতে পারে সেটা আর্থিক, রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক। তাহলে কি আমরা নিরেপেক্ষ? প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাকের ফক্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় দেখিয়েছিলেন যে " নিরপেক্ষতা " ছোট দেশগুলিকে বড় ধরনের সঙ্কট থেকে বাঁচাতে খুব ভাল সাহায্য করেছিল। অনেকগুলি ছোট ইউরোপীয় রাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে বেঁচে গিয়েছিল বরং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তিনি মনে করেন, সুইডেন, স্পেন, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং পর্তুগাল তাদের সরকারের কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে 'নিরপেক্ষ' থেকে সফল হয়েছিল। তবে নিরপেক্ষ তাই মহৌষধ নয়।

অনেক ছোটো দেশ নিরপেক্ষ থেকেও শেষ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, নরওয়ে এবং ডেনমার্ক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল তাদের নিরপেক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে নয়, বরং এটি হিটলারের পরিকল্পনার অংশ ছিল। সুতরাং কোনও ছোট দেশের 'নিরপেক্ষতা' যদি সাফল্যের কোনও সম্ভাবনা থাকে তবে পরাশক্তিরা তাকে রাজনৈতিক বলি বানাতেই পারে। সেরকম আশঙ্কা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ত অবশ্যই রয়েছে।

তাহলে উপায় কি? আপাত দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত কূটনীতির মারপ্যাচে বাংলাদেশ কে সফল বলা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে এখনো পর্যন্ত খুব দক্ষতার এবং সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা বলা খুব মুশকিল। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কি নীতি গ্রহণ করে সেটাও একটা ব্যাপার। বর্তমানে নিরেপক্ষ হলেই যে সব সময় একই নীতি কার্যকর হবে সেটাও নয়। কানাঘুষা আছে বর্তমান সরকার গঠনে ভারত এবং চীন উভয় দেশেরই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমর্থন ছিল। হয়তও চীন- ভারত দুই দেশই সরকারের সমর্থন আশা করবে। আকাশ সংস্কৃতি আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে একদেশের নেতা নেতৃবৃন্দ, জনগনের মনোভাব খুব সহজেই জানা যায়। অনেক ভারতীয় মিডিয়া যেমন বাংলাদেশের উপর চোখ রাখে তেমনি সিনহুয়া, চি আর আই এর মত চাইনিজ মিডিয়াও বাংলাদেশে খুব কর্মচঞ্চল। ব্যাক্তিগত, দলীয় আশা আকাঙ্খার উর্ধে উঠে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজনদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তবেই " ঘাস " ট্যাগ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে। সেই মুক্তিতেই হাতিরা আর হাতি থাকবেনা আমাদের কাছে। সেই সোনালী দিনের প্রত্যাশা বোধ হয় এখন প্রতিটি দেশবাসীর।

মিরাজ আহমেদ (পি এইচ ডি)
সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইনান্স এন্ড ইকোনমিকস