বিশ্লেষণ : ধর্ষকরা কেন ধর্ষণ করে?


Dhaka | Published: 2020-09-27 02:33:52 BdST | Updated: 2024-09-29 04:49:41 BdST

মধুমিতা পাণ্ডে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে পি.এইচ.ডি করছেন। নিজের গবেষণার জন্য ২২ বছর বয়সে তিনি দিল্লির তিহার কারাগারে যান এক ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিতে।

এরপর থেকে গত তিন বছর ধরে একের পর এক ১০০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। জানতে চেয়েছেন, “কারা এরা? আমরা এদের রাক্ষস বলি, অমানুষ বলি - কিন্তু এই মানুষগুলো কেন ধর্ষণ করে? নিজেদের অপরাধ নিয়ে কী ভাবে তারা?” তার সেই অভিজ্ঞতা আর গবেষণার ফলাফল নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।

দিল্লির ’নির্ভয়ার’ কথা আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯ টায় ডাক্তারি পড়ুয়া জ্যোতি সিং পাণ্ডে এবং তার বন্ধু অন্দ্র সিং পাণ্ডে ‘লাইফ অব পাই’ সিনেমাটি দেখে বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন।

পরে ঐ বাসের চালকসহ মোট ৭ জন অন্দ্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে আর তারপর গণধর্ষণ করে জ্যোতিকে। এর ১৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, নিউমোনিয়া এবং তলপেটে জীবাণু সংক্রমণে মারা যায় জ্যোতি।

এই ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো ভারত এবং ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বাইরেও। জ্যোতিকে ‘নির্ভয়া’ এবং ‘ডটার অব ইন্ডিয়া’ উপাধি দেয়া হয়। সে বছর জেন্ডার বিশেষজ্ঞগণ জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে ভারতকে নারীর জন্য সবচাইতে অনিরাপদ দেশ বলে ঘোষণা দেন।

এমনকি সৌদি আরব, যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে কোন না কোন পুরুষের অভিভাবকত্বের অধীনে থাকতে হয় নারীকে, সেই সৌদি আরবের চেয়েও ভারতের পরিস্থিতিকে নিকৃষ্ট ঘোষণা করেন তারা।

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ভারতে শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ৩৪,৬৫১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

২০১২ সালের ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণের ঘটনার পর ভারতে নারীর প্রতি সহিংসতা আর ধর্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ।

দিল্লির বাসিন্দা মধুমিতা পাণ্ডে তার শহরকে এক নতুন আলোয়, নতুন আগুনে জ্বলে উঠতে দেখেন। পৃথিবীর আরেক প্রান্ত ইংল্যান্ডে বসে আর সবার মতো তিনিও বলে ওঠেন - “এরা অমানুষ, এরা রাক্ষস”, মনে মনে তিনি প্রশ্ন করেন - “এই লোকগুলো এই কাজ কেন করে?”, “কোন সামাজিক পরিস্থিতিতে এধরণের মানুষ তৈরি হয়? “

অতঃপর ২০১৩ সালে নিজের গবেষণার কাজ শুরু করেন মধুমিতা। প্রথমে ছোট পরিসরে একটি পাইলট প্রজেক্টের মতো করে কাজ শুরু করেন তিনি। তারপর মাসের পর মাস দিল্লির তিহার জেলে ধর্ষকদের সঙ্গে কথা বলে কাটান তিনি, নেন একের পর এক সাক্ষাৎকার।

মধুমিতা দেখলেন- এই ধর্ষকদের অধিকাংশেরই নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যাও সামান্য কয়েকজন আছে, তারা মোটে হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন। অনেকেই তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণির বেশি আর পড়ালেখা করেনি। মধুমিতা টের পেলেন, এরা রাক্ষস নয়, অদ্ভুত কোন জীব নয়, আর দশটা মানুষের মতো নিতান্তই সাধারণ। তারা ধর্ষণ করেছে তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারণে, চিন্তার জগতে পারিবারিক আর সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে।

ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মধুমিতা লক্ষ্য করলেন এখনও ভারতীয় গৃহস্থালীগুলোতে স্বামীকে নাম ধরে ডাকা রীতিবিরুদ্ধ। গবেষণার অংশ হিসেবে নিজের বেশ কয়েজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন মধুমিতা, জিজ্ঞেস করেন তাদের মায়েরা নিজেদের স্বামীদের কী বলে ডাকেন। উত্তরে প্রায় সবাই বলেছেন, ‘এই শুনছো’, ‘শোনো’ কিংবা ‘ রওনকের বাবা’(সন্তানের নাম) ইত্যাদি নামেই তাদের মায়েরা ডাকেন নিজেদের স্বামীদের।

এভাবে ছোটবেলা থেকেই পৌরুষত্বের ভুল ব্যাখ্যা শেখেন আমাদের সমাজের পুরুষরা, আর নারীরা শেখেন কি করে পুরুষদের অধীনে থাকতে হয়। মধুমিতা পাণ্ডে বলেন, “সব ঘরেই এমনটা হচ্ছে। আমরা মনে করি এই ধর্ষকদের হয়তো জন্মগত কোন ত্রুটি আছে । কিন্তু না, এরা বাইরের দুনিয়া থেকে আসা কোন এলিয়েন নয়। বরং এই পৃথিবীর সমাজেই এরা বেড়ে উঠেছে।”

মধুমিতা আরও বলেন, “এই ধর্ষকদের একটা মারাত্মক বৈশিষ্ট্য আছে। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনি এদের প্রতি হঠাৎ সহানুভুতিশীল হয়ে উঠতে পারেন। অন্তত একজন নারী হিসেবে এমন অনুভব করা আমার জন্য স্বাভাবিক নয়। তবুও এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে এরা একেকজন ধর্ষক। আমি খেয়াল করলাম এদের অধিকাংশই মনে করে না যে এরা ভয়ানক অপরাধ করেছে, অপর পক্ষের ‘সম্মতি’ - এই শব্দটার মানেই জানে না তারা।”

তখন মধুমিতা নিজেকে আবার প্রশ্ন করেন, “এই মানসিকতা কি শুধু এই অশিক্ষিত মানুষগুলোর, নাকি পুরুষ সমাজের একটা বিশাল অংশের একই হাল? তারা কি ‘সম্মতি’ শব্দটার মানে বোঝে?”

অত্যন্ত রক্ষণশীল সামাজিক পরিস্থিতির দেশ ভারত। স্কুল শিক্ষার কারিকুলামে কোথাও ‘সেক্স এডুকেশন’ বা যৌন শিক্ষার পাঠ নেই।

নীতি নির্ধারকরা মনে করেন এতে করে অবক্ষয়প্রাপ্ত হবে তরুণ সমাজ আর ধর্মীয়-সামাজিক প্রথার অবমাননা করা হবে। গবেষণা করতে গিয়ে মধুমিতা দেখলেন, ‘শিশ্ন বা পেনিস, জরায়ু বা ভ্যাজাইনা, সেক্স , ধর্ষনের মতো শব্দগুলো অভিভাবকরা সন্তানদের সামনে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না। তারা নিজেরাই যদি এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, তবে নিজের ছেলে সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেবেন তারা?”

সাক্ষাৎকারগুলোতে অধিকাংশ ধর্ষকই ধর্ষণেরর পেছনে কারণ দেখিয়ে নিজেদের সাফাই দিয়েছে । এমনকি ধর্ষণেরর ব্যাপারটাকেই অস্বীকার করেছে অনেকে। বাকিরা নানারকমে দোষ দিয়েছে ধর্ষণেরর শিকার মেয়েটিকেই।

একটি কেস তো মধুমিতাকে রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে। ৪৯ বছর বয়সী এই ধর্ষক ধর্ষণ করেছে ৫ বছর বয়সের এক শিশুকে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, “হ্যাঁ, আমার সত্যিই খারাপ লাগছে, আমি মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। মেয়েটা তো আর কুমারী রইলো না, এখন আর কে ওকে বিয়ে করবে? আমি ওকে গ্রহণ করবো, জেল থেকে ছাড়া পেলে ওকে বিয়ে করব আমি।”

এই উত্তরে মধুমিতা এতটাই হতভম্ব হয়ে পড়েন যে ধর্ষণেরর শিকার মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে বের করেন তিনি। সেখানে গেলে মধুমিতাকে মেয়েটির মা জানালেন - তাদের মেয়ের ধর্ষকটি যে জেলে আছে সমাজের কারও কাছে সে কথা প্রকাশই করেননি তারা।

সামনের কোন এক মাসে গবেষণাটি প্রকাশ করতে চান মধুমিতা পাণ্ডে, কিন্তু নিজের কাজের জন্য বেশ কিছু বিপত্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। তিনি বলেন, “সবাই হয়তো বলবে - ‘ঐ দেখ আরেক নারীবাদী চলেছে’ - এরা মনে করে এই গবেষণা পুরুষদের চিন্তা ভাবনার ভুল ব্যাখ্যা দিতেই করেছি আমি। কী করে এদের বোঝাবেন বলুন?”

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট