-2020-11-13-21-28-09.jpeg)
হুমায়ূন আহমেদ তার মাতাল হাওয়ায় ছাত্রদের রাজনৈতিক বিভাজন চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। তিনি ’৬৮-’৬৯ সালের প্রেক্ষাপটে লেখেন, ‘সেই মাতাল সময়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক বিভাজন ছিল এরকম:
ছাত্র ইউনিয়ন: যারা এই দলে ধরেই নেওয়া হতো, তাদের মধ্যে মেয়েলিভাব আছে। তারা পড়ুয়া টাইপ। রবীন্দ্রনাথ তাদের গুরুদেব। এরা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করে। গানবাজনা, মঞ্চনাটক জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিতি থাকে। এদের ভাষা শুদ্ধ। নদীয়া শান্তিপুর স্টাইল। যে-কোন বিপদে-আপদে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে এরা পারদর্শী। মিছিলের সময় পালানোর কথা বিবেচনায় রেখে এরা পেছন দিকে থাকে।
এই দলটির আবার দুই ভাগ। মতিয়া গ্রুপ, মেনন গ্রুপ। একদলের উপর চীনের বাতাস বয়, আরেক দলের উপর রাশিয়ার বাতাস বয়।
ছাত্রলীগ: পড়াশোনায় মিডিওকার এবং বডি বিল্ডাররা এই দলে। এই সময়ে তাদের প্রধান কাজ এনএসএফ-এর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সামনে তারা খানিকটা হীনমন্যতায় ভোগে। মারদাঙ্গায় এবং হলের ক্যান্টিনের খাবার বাকিতে খাওয়ায় এরা বিশেষ পারদর্শী।
ইসলামী ছাত্রসংঘ: মওদুদীর বই বিলিয়ে ‘দীনের দাওয়াত দেয়া’ এদের অনেক কাজের একটি। পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করা, মসজিদ ভিত্তিক সংগঠন করা এদের কাজ। দল হিসেবে এরা বেশ সংঘটিত। কথাবার্তা মার্জিত। অনেকের বেশ ভালো পড়াশোনা আছে।
এনএসএফ: প্রধান এবং একমাত্র কাজ সরকারি ছাতার নিচে থেকে গুণ্ডামি করা। সরকার এদের ওপর খুশি। কারণ, এদের কারণে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন।
এছাড়াও হুমায়ূন তার মাতাল হাওয়া’য় আইয়ুবের গুণ্ডা বাহিনী এনএসএফ এর নানা অন্যায়ের বর্ণনা দেন।
এনএসএফ এর গুন্ডারা বাইরে থেকে মেয়ে ভাড়া করে এনে হলের সামনে নগ্ন করে নাচাতো।
হুমায়ূনের পড়াশোনা
বাইরে অশান্ত রাজনৈতিক অবস্থা। কিন্তু হুমায়ূন মগ্ন হয়ে আছেন তার বইয়ের রাজ্যে। মহসিন হলের দরজা বন্ধ করে পড়েন রসায়নের কঠিন কঠিন বই। সাহিত্যের বইও পড়ছেন সমান তালে। টমাস হার্ডির লেখা ‘পেয়ার অব ব্লু আইজ’সহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি লেখকের বই।
হুমায়ূন লেখেন:
‘এই জাতীয় কোন সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার প্রশ্নই আসে না। আমি পড়াশোনা নিযে থাকি। বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ছয় আনা খরচ করে দুটা গরম গরম সিঙ্গারা এবং এককাপ চা খেয়ে শরিফ মিয়ার কেন্টিনের সঙ্গে লাগোয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে যাই। গল্প-উপন্যাস পড়ি। ’
একবার মহসিন হলে বসে এএসএফ-এর এক গুন্ডাকে হুমায়ূন আহমেদ সম্মোহিত (হিপনোটাইজড) করে ফেলেন। ফলে সবাই তাকে ভয় ও সমীহ করা শুরু করে। উত্তপ্ত রাজনীতি থেকে সরে নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে তিনি এমনিভাবে আশ্রয় নেন বিভিন্ন কৌশলের।
হুমায়ূন লিখেছেন:
‘পরিস্থতি বৈরী হলে শামুক তার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে যায়। আমার কাছে পরিস্থিতি বৈরী মনে হলো। চলমান উত্তপ্ত ছাত্র রাজনীতির বাইরে নিজেকে নিয়ে গেলাম। বিচিত্র এক খোলস তৈরী করলাম। সেই খোলস ম্যাজিকের খোলস, চক্র করে ভূত নামানোর খোলস। তখন হাত দেখাও শুরু করলাম। হাত দেখে গড়গড় করে নানান কথা বলি। যা বলি তাই না-কি মিলে যায়।
‘আমাকে এখন আর কেউ ঘাঁটায় না। আমি মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে মানুষের মাথার খুলি এনে চিকন সুতা দিয়ে আমার ঘরে এক কোনায় ঝুলিয়ে দিলাম। দেওয়ালের রঙ সাদা, সুতার রঙও সাদা। ব্লাক আর্টের মতো তৈরী হলো। হঠাৎ দেখলে মনে হতো মানুষের মাথার একটা খুলি শূন্যে ভাসছে। বেশ কয়েকজন এই দৃশ্য দেখে ছুটে পালায়। ’
মহসিন হল থেকে মিসির আলী
মহসিন হলের একটি বিস্ময়কর ঘটনাই হুমায়ূন আহমেদকে মিসির আলী লিখতে অনুপ্রাণিত করে। মূলত মিসির আলীর সৃষ্টিই হয় মহসিন হল থেকে। একদিন সবাই মিছিলে মিটিং নিয়ে ব্যস্ত, হুমায়ূন আহমেদ ব্যস্ত তার বইয়ের রাজ্যে। মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করেন হলের করিডোরে।
তিনি মাতাল হাওয়ায় লেখেন, ‘কল্পনার বকুলগন্ধা তরুণী পাশে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় এক কণ্ঠ কানে এলো ডিম ভাজার শব্দ। প্রতিটি রুম তালাবদ্ধ। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে একটা ঘরের ভেতর ডিম ভাজা হচ্ছে, এর অর্থ কি? কানে কি ভুল শুনছি? যে রুম থেকে ডিম ভাজার শব্দ আসছে আমি তার সমনে দাঁড়ালাম। চামচের টুংটাং শব্দ। পায়ে হাঁটার শব্দ। দরজায় টোকা দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দের অবসান। আমি নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। রহস্যের কিনারা করতে হবে। (পাঠক, মিসির আলির জন্মলগ্ন)। রহস্যের সমাধান করলাম। ’
পরে হুমায়ূন আহমেদ হাউস টিউটরকে জানান, একটি কক্ষে মেয়ে আছে। কেউ বিশ্বাস করলো না। পরে রুম চেক করে কাপড় রাখার কাবার্ডে পাওয়া গেল এক তরুণীকে। বিয়ে করে লুকিয়ে রেখেছেন এক ছাত্র। তাদের আর কোনো জায়গা ছিল না।
এ ঘটনাকেই হুমায়ূন আমেদ মিসির আলির জন্ম লগ্ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।