বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’!


Dhaka | Published: 2020-11-17 05:01:38 BdST | Updated: 2024-05-21 21:43:44 BdST

ভিলেজ পলিটিক্স বা ‘গ্রাম্য রাজনীতি’র ধারণাটি আমাদের কাছে একটু নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি পারিবারিক বিতর্কিত বিষয়াদির বেলায়ও আমরা অহরহই বলে থাকি- ভিলেজ পলিটিক্স করবি না। এই ভিলেজ পলিটিক্সের প্রকৃত কোনো সংজ্ঞা বা রূপ বই-পুস্তকে অথবা কোনো গণমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝলাম, এটি এক ধরনের মিশ্র ধারণা, যার কোনো নির্দিষ্ট গতিপ্রকৃতি নেই। তবে গুণগত দিক দিয়ে অতিশয় নিম্নমানের। গ্রামের প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর, প্রতিপত্তিশালীরা এ ধরনের রাজনীতির চর্চা করে থাকেন। এ ধরনের রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি-নৈতিকতা থাকে না, থাকে না কোনো রাজনৈতিক দর্শন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও ইশতেহার। নথিপত্রের প্রয়োজন হয় না এ রাজনীতিতে।

প্রথমে কানে কানে, তারপর জনে জনে এবং সবশেষ ঢাল-সড়কিতে। সবুজ ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ এবং শান্ত-সরল মনের মানুষের যে অপূর্ব গ্রামের কথা আমাদের মাথায় বাসা বেঁধেছে, তার সঙ্গে এ ধরনের রাজনীতি বড়ই বেমানান। কোনো সালিশির ক্ষেত্রে কান কথায় ভর করে মাতব্বর যে রায় দেবেন, তার প্রতিবাদ করলে জুতাপেটা কিংবা একঘরে, আর সবকিছু মেনে নিলে মনযন্ত্রণা! এখানে যুক্তিতর্ক বলে কিছু নেই। নানা রকমের ব্যক্তিগত কুৎসা আর গিবতের ভেতর দিয়ে সত্যের চলা বন্ধ হয়ে যায়। কুৎসা রটনাকারীর সংখ্যা একসময় সমাজে খুব কম ছিল। সাধারণ মানুষ এদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারত না, কারণ এরা ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় থাকত। তবে মন থেকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করত। গ্রামীণ ভাষায় এদের পুরুষ হলে ‘কূটনা’ আর নারী হলে ‘কূটনি’ বলা হতো। তাদের কর্মপ্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে ‘কূটনামি’। আড়ালে থেকে কথা চালাচালি করা কিংবা কুৎসা রটনাকারীদের বসবাস প্রধানত গ্রামাঞ্চলেই ছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছে। এটি এখন আর গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শহরেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। শহরের পাড়ায়-মহল্লায় এখন এর ব্যাপক চর্চা হয়। কোনো বিষয়ে প্রকৃত যাচাই-বাছাই নেই, শুনলাম বলেই মারধর। যেহেতু গণমাধ্যম ও যোগাযোগের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, তাই এই ‘কূটনামি’র বিস্তৃতি হয়েছে দেশময়। সব শ্রেণির, সব স্তরের মানুষ এখন কুৎসা রটানোর কাজে গণমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে। চর্চাটি এতই সহজ ও বিশাল যে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটাও একরকম অসম্ভব। তাছাড়া মানুষের নিত্যদিনের কাজ থাকে। সেসব কর্ম সেরে রটনাকারীদের পেছনে ছোটার ফুরসত কোথায়!

গ্রাম থেকে শহর, শহরের সাধারণ সমাজ থেকে কুৎসাকারীদের পদচারণা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেছে। এ ধরনের ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের জন্যে মনে হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে উর্বর জায়গা। ৩০ বছর ধরে এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হতে আজ তা শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে এই তিন দশকে ‘কূটনামি’র গতিপ্রকৃতি বদল হয়েছে। ১৯৯০ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় তার কার্যক্রম শুরু করে তখন কুৎসার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি মাদ্রাসার আদলে ছিল। কোনো ছাত্রী ছিল না, কোনো নারী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল না, কোনো অমুসলিমের উপস্থিতি ছিল না। সব মিলিয়ে একটি রক্ষণশীল পরিবেশ ছিল। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এ পরিস্থিতিকে অনেকটাই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করেন এবং সেসব প্রথা তুলে দিয়ে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দেন। স্বাভাবিকভাবেই এই উদারনৈতিক পরিবেশ, কো-এডুকেশন ব্যবস্থাকে রক্ষণশীলরা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। এটা তাদের অন্যায় বলব না; বরং যে মনন নিয়ে তারা বেড়ে উঠছিল তার সঙ্গে ওই পরিবেশের সংঘাত অনিবার্য ছিল। আর এর কারণ যেহেতু ভিসি, তাই তার নামে স্থানীয় পত্রিকা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে দেয়ালে নানা কুৎসা রটানোর ঘটনা নিজের চোখে দেখা। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার আভাস ছিল। তবে কুৎসার একটা বড় দুর্বলতা হল এর স্থায়িত্ব। অতি স্বল্প স্থায়িত্বের অপবাদগুলো উপাচার্যকে কাবু করতে পারেনি।

লিফলেট ছড়িয়ে কুৎসা রটনা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সংযোগ ছিল না। নিতান্তই ব্যক্তিবিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে একজন শিক্ষককে হেয়প্রতিপন্ন করা। কিন্তু ওই যে বললাম দুর্বলতার কথা। যাদের নামে কুৎসা রটানো হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হতো বাইরে থেকে। ২০০৬ সালে প্রথম অভ্যন্তরীণভাবে নিয়োগ দেয়া হয় অধ্যাপক ফয়েজ মোহাম্মদ সিরাজকে। তারপর থেকে কুৎসার উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে প্রফেসর সিরাজ ইস্তফা দিয়ে ঢাকা চলে যান। অন্য ভিসি নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত প্রফেসর সিরাজ ঢাকায় বসে রুটিন কাজ করতেন। এরই মধ্যে ভিসি হওয়ার লড়াই শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু পরিষদ মোটা দাগে দু’ভাগ হয়ে যায়। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামে চলে নানা আকথা-কুকথা। ‘কূটনামি’ তার নতুন গন্তব্য হিসেবে বেছে নিল সচিবালয়। সত্য-মিথ্যা অভিযোগে সম্ভাব্য দুই প্রার্থীর ফাইল ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। শেষ পর্যন্ত প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিনের ললাটে ভিসি পদটি জোটে। গত ৫ বছরে কাউকে হেয় করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ফোনালাপ। কোন শিক্ষক-কর্মকর্তা কোন নারীর সঙ্গে ফোনে কী বললেন, তা যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া। মজার ব্যাপার হল, এক্ষেত্রে কোনো অভিযোগকারী নেই। সে ফ ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে এ ধরনের প্রচারণা। নিজের লাভ হল বা না হল- অন্যকে তো হেয় করা গেল! মানুষের হাতে সময় কোথায় যে এসব খুঁটিয়ে বের করার চেষ্টা করবে!

মাসখানেক আগে ভিসি বদল হয়েছেন। নতুন ভিসি নিয়োগদানের আগে প্রায় দু’মাস ধরে চলে তুঘলকি কাণ্ড। একদল চাচ্ছিল আগের ভিসিই আবার নিয়োগ পান; অন্যদল চাচ্ছিল- আর যেই হন, আগের ভিসি যেন না থাকতে পারেন। ব্যাস! শুরু হয়ে গেল কাদা ছোড়াছুঁড়ি। সচিবালয়ের নথিতে যোগ হতে লাগল একের পর এক নিন্দাজ্ঞান। শেষতক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামকে নিয়োগ দিয়ে তার সমাধা করা হল। আগেই বলেছি, কুৎসা রটনা তার গতিপথ পরিবর্তন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়ম নিয়ে গত দু’বছরে আমি যুগান্তরে তিনটি নিবন্ধ লিখেছি, সেখানে কারও নাম উল্লেখ করিনি। তবু যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে তারা যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসাজ্ঞান করতে লাগল। তিনটি ক্ষেত্রেই ভাষা ও বিষয়বস্তু অভিন্ন। সে আমার সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমার এক সহকর্মী জানালেন কোথায়, কোন পোর্টালে যেন আমাকে একই ভাষায় নিন্দাজ্ঞান করা হয়েছে। এবারে কিছুটা বিস্মিত হলাম। কেননা এ সময়ে তো কোনো স্বার্থান্বেষী মহলকে আঘাত করে কিছু লিখিনি। তারপর যখন পুরোটা দেখলাম তখন আরও অবাক হলাম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারারের পদ খালি আছে। আমাকে তারা সে পদের একজন সম্ভাব্য প্রার্থী মনে করে আগাম পিছু টেনে ধরেছে। নিন্দার উপাদানগুলো একই। অথচ প্রকৃত সত্য হল, কারও কাছে কোনো পদের জন্য একটি বাক্য বা একটি বর্ণও খরচ করিনি। কেউ যদি কিছু না চায়, তারপরও আগ বাড়িয়ে সরকার থেকে তাকে পদায়িত করার সংস্কৃতি কি হালের বাংলাদেশে আছে? তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদগুলো তো দলকানা লোকদের জন্য, এর বাইরে ভাবার সুযোগ আছে কি? আমি সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করি, মন্দ কাজের সমালোচনা করি। তাই আমাকে এ পদে প্রত্যাশা করাটা অবাস্তব।

এক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন আসতে পারে যে, এ নিয়ে যদি আপনার কোনো আগ্রহই না থাকবে, তাহলে প্রসঙ্গটির অবতারণা কেন? জবাবটা হল- দুঃখবোধ। আমার এক পরীক্ষিত ছাত্র। আমি চার বছর তাকে পড়িয়েছি এবং ২৫ বছর ধরে সহকর্মী হিসেবে বিভাগে কাজ করছি। আমার ছাত্রটি অত্যন্ত মেধাবী, সৎ, পরিশ্রমী, ভদ্র, বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদিত অংশের সদস্য এবং প্রগতিশীল আচরণে সমৃদ্ধ। শুনেছি তাকেও ট্রেজারার হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে তো কুৎসায় নামতে হবে। কিন্তু ওর তো কোনো নেতিবাচক দিক নেই। না থাকলেও তৈরি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাকে অপবাদ দেয়া হল, আজ থেকে ৩০ বছর আগে তার নাকি বিএনপি সংশ্লিষ্টতা ছিল। মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে! ৩০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট একজন মানুষকে সামান্য একটি পদের জন্য একরাতে বিএনপি বানানো হল? এটা আওয়ামী সংস্কৃতির নতুন ধারা। কাউকে পছন্দ না হলেই বিএনপি-জামায়াতের তকমা লাগানো। অপকাণ্ডটি আমাকে আহত করেছে। কারণ শিক্ষকের কাছে একজন ছাত্র সর্বদাই সন্তানতুল্য, তার অপবাদ আমার অপমান।

ছোটবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম- ‘বাপ মরে গেছে সে জন্যে কান্দি না, কান্দি যমে যে বাড়ি চিনছে।’ এসব পদের মীমাংসা হয়তো কয়েকদিনেই হয়ে যাবে; কিন্তু কুচক্রী মহলের অপকাণ্ডের বিলোপ সাধিত হবে কি? ঘটবে কি গ্রাম্য রাজনীতির অবসান?

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়