উন্নত বিশ্বে গবেষণা চুরির (Plagiarism) শাস্তি কি ?


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2017-09-30 04:24:11 BdST | Updated: 2024-05-11 20:34:21 BdST

অনেকে প্লাগিয়ারিজমকে "অনেস্ট মিসটেক" বলে চালিয়ে দিতে চান। কিন্তু একাডেমিয়াতে এই "অনেস্ট মিসটেক"কে খুব সহজে গ্রহণ করা হয়না। প্লাগিয়ারিজম একাডেমিয়াতে মহাপাপ। উন্নত দেশে প্লাগিয়ারিজম শাস্তি হচ্ছে, ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া/ ডিগ্রি বাতিল করা এবং প্রফেসরশীপ চলে যাওয়া।

অন্যের আইডিয়া বা ধারণা নিজের লেখায় কোট করতে হলে, সঠিকভাবে তার রেফারেন্স বা সাইটেশন দিতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বড় অংশ আছেন, যাদের একাডেমিক অনেস্টি/ইন্ডেগ্রিটি এবং প্লাগিয়ারিজম সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই বা দেয়া হয়না ।

প্লাগিয়ারিজম(Plagiarism) কি?

একে সহজ ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলা যায় অন্যের অনুমতি ছাড়া কোন কিছু নিজের বলে দাবি করা। বইয়ের ভাষায় অন্যায়ভাবে অন্যের আইডিয়া, কর্ম, ভাষা, ভাব-ভঙ্গি, ইত্যাদি নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া বা দাবি করাকেই প্লাগিয়ারিজম বলে। সোজা বাংলায় যাকে বলে নকল করা বা চুরি করা। আমাদের দেশে টেক ব্লগিং জগতে জেনে না জেনে অনেকই অন্যায় কাজটি করে থাকেন। কিন্তু এটার জন্য যে পরিমান ক্ষয় ক্ষতি হয় তাও স্বয়ং প্লাগিয়ারিষ্ট(চোর) নিজেও খেয়াল করেননা। বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হতে পারে এক্ষেত্রে। মেধার অপচয়, সময়ের অপচয়, আর্থিক জরিমানা, জেল-জরিমানা, চুরির গ্লানি, সর্বোপরী সামাজিকভাবে নিচ হিসেবে গন্য হওয়া। অবুঝরা না হয় এটা না জেনে করে থাকেন। কিন্তু যখন বুঝের ব্যাক্তিরা এর সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করেন তখন এটাকে ঠিক কোন ধরনের অপরাধ বলা যাবে তার সঙ্গায়িত করার ভাষা আমার নেই, আপনারাই সেই দায়িত্বটুকু পালন করুন। 

Plagiarism এর শাস্তিসমূহঃ 
বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র (যার Plagiarism এর সম্পর্কে ধারনা থাকার কথা বেশ কম) থেকে শুরু করে আমেরিকার অনেক বড় বড় প্রফেসরও Plagiarism এর দোষে দুষ্ট। ইউ এস এর গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের এথিক্স ক্লাস করতে হয় এবং মজার ব্যাপার হল, আমাদের যিনি এই ক্লাসটা নিয়েছেন এবং Plagiarism এর সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন, বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছিলাম , তাঁর নিজের রিসার্চ গ্র্যান্টই নাকি একবার Plagiarism এর দোষে দুষ্ট ছিল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, প্রফেসররা ক্লাস নেয়ার সময় অনেকেই সরাসরি উইকি থেকে কপি করে দিয়েছেন অথচ নিচে সোর্স উল্লেখ করেননি। অথচ এরাই বড় বড় কথা বলে আর ছাত্রদের দোষ ধরে। এ যেন কৃষ্ণ করলে লীলাখেলা আর আমি করলে দোষ।

যাই হোক, বলছিলাম Plagiarism এর শাস্তির কথা । আমি কিছুক্ষন আগে একটা লেভেল এর কথা বলেছিলাম। এটাকে অ্যাকসেপ্টেবল লেভেলও বলতে পারেন। এর বেশি হলে আপনি সমস্যায় পড়তে পারেন যার চূড়ান্ত শাস্তি হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি বেশ কমন একটি ঘটনা। তবে অনেক সময় সেটা ক্লাস শিক্ষকের উপরে নির্ভর করে । যদি শিক্ষক আপনাকে মাফ করে দেন এবং ভার্সিটিকে না জানান তাহলে আপনি বেঁচে যাবেন। আর যদি মাফ না করেন তাহলে আপনাকে লাদেন হয়ে ঘুরতে হবে।শাস্তির কিছু ধাপ আছে এবং সেটা নির্ভর করে আপনি কত মারাত্নক Plagiarism করেছেন এবং কিভাবে করেছেন তার উপরে।

যদি ব্যাপারটা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জেনে না যায় এবং আপনার Plagiarism এর লেভেল ক্ষমাযোগ্য পর্যায়ে থাকে তাহলে আপনি হয়ত সাময়িক warning পেতে পারেন। আবার যদি একটু বেশি থাকে এবং আপনার পূর্বের কোনো খারাপ রেকর্ড থাকে তাহলে আপনার অবস্থা আরেকটু খারাপ হতে পারে যেমন কিছুদিন এর জন্য suspension অথবা আপনাকে probation এ রেখে দিতে পারে। আর সর্বশেষ শাস্তি হলো, ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দিবে, একেবারে dismissal । এটা হলে আপনার বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রতি বছরই বেশ কিছু ছাত্র বের হয়ে যায় শুধু Plagiarism এর জন্য।আমি এমনও শুনেছি পি এইচ ডি ডিগ্রীর ডিফেন্স হয়ে যাবার পরেও সেই ছাত্রকে ডিগ্রী দেয়া হয়নি Plagiarism এর কারনে। কথা প্রসঙ্গে বলি , আমি এই শাস্তির মাপকাঠিটা লিখলাম আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মাথায় রেখে। আবারো বলছি, আপনার শাস্তি পাবার সম্ভাবনা থাকবে আপনি কোন শিক্ষকের পাল্লায় পড়েছেন অথবা আপনার দোষের মাত্রাটা কতটুকু পর্যায়ে গিয়েছে। 

যেভাবে Plagiarism রুখবেনঃ  
যদি আপনি সরাসরি কোনো বাক্য কপি করে লিখতে চান তাহলে অবশ্যই কোটেশন চিহ্ন ব্যবহার করবেন আর সুত্রের কথা উল্লেখ করবেন। এবার আসুন পেপার লেখার ব্যাপারে। আমি যতটুকু জানি, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রদের জন্য turnitin.com এর অ্যাকাউন্ট নেই। কোনো পেপার, টার্ম পেপার অথবা থিসিস পেপার তাই সরাসরি কোর্স শিক্ষক অথবা সুপারভাইজর এর কাছে জমা দিতে হয়। কিন্তু তার আগে আপনি নিজে দেখবেন কিভাবে। www.turnitin.com এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখুন একটা অপশন আছে Products নামে। ওখানে ক্লিক করে পাবেন writecheck for students নামে আরেকটি অপশন। এটি তৈরী করা হয়েছে মূলত ছাত্রদের জন্য অথবা যেসব শিক্ষকের turnitin এ অ্যাকাউন্ট নেই তাদের জন্য। আমি ওদের সাথে কথা বলে এবং এই ওয়েবসাইট থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হল, writecheck মূলত turnitin এর ডেটাবেস-ই ব্যবহার করে। তাহলে turnitin এর অ্যাকাউন্ট থাকার বাড়তি সুবিধা কোথায় ? বেশ কিছু আছে, যেমন আপনি যদি writecheck এ গিয়ে কোনো পেপার ম্যাচ করতে দেন তাহলে আপনাকে কোন কোন শব্দ পাশাপাশি ম্যাচ হয়েছে সেগুলো দেখাবে যাতে আপনি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নিতে পারেন। কিন্তু turnitin আপনাকে দেখাবে আপনি কোথাথেকে কপিটা করেছেন। এমনকি যদি একাধিক যায়গা থেকে কপি করে থাকেন তাহলে শব্দ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে কত পারসেন্টেজ কোথা থেকে ম্যাচিং হয়েছে তাও দেখাবে। প্রতিবার চেক করার ক্ষেত্রে writecheck আপনার কাছ থেকে নিবে ৪.৯৫ ডলার তাও আবার এই টাকায় ৫০০০ শব্দের বেশি পেপার চেক করতে পারবেননা। তারপরও, ছাত্রদের পিঠ বাঁচানোর জন্য এটি ভাল একটি উপায়। writecheck ব্যবহার করার একটি সুবিধা হলো, এখানে চেক করা পেপারগুলোর অ্যাক্সেস turnitin এর থাকেনা। সুতরাং আপনার সুপারভাইজর অথবা শিক্ষক জানতে পারবেননা যে আপনি আগে পেপারটা চেক করে নিয়েছেন কিনা।  

আপনার কাছে ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড নাও থাকতে পারে, তারা কি করবেন? যদি সম্ভব হয়, তাহলে কার্ড আছে এমন কোনো বন্ধুকে বলুন সাহায্য করতে। আর যদি একেবারেই কোনো সাহায্য না পান তাহলে একটা অতি সহজ সরল বুদ্ধি দেই। পেপার লেখার সময় বাক্যগুলো গুগল এ দিয়ে সার্চ দিন। দেখুন ম্যাচিং কতটুকু আসে। আমার পরিচিত এক পোস্টডক-যার নেচার সহ বেশ ভালো কয়েকটি জার্নালে পেপার আছে, এভাবে কাজ করতে দেখেছি। উনি পেপার লেখা থেকে শুরু করে গ্র্যান্ট লেখার কাজটিও এভাবে করেন। এই বুদ্ধিটা কিছুটা হলেও কাজে দেয়।

একটা সাবধানবানী দিয়ে রাখি। ধরুন আপনার পরিচিত কারো turnitin এ অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনার পেপার সাবমিট করার আগে তাকে দিয়ে চেক করাবেননা। কারন কোনো পেপার turnitin এ দেয়ার পরে সেটা ওদের ডেটাবেসের অংশ হিসেবে থাকে। এরপরে আপনার শিক্ষক যদি আবার আপনার পেপার রান করেন তাহলে ম্যাচ ত পাবেনই এমনকি কোথায় এটি রান করা হয়েছে সেটিও দেখতে পারবেন। তখন উলটো সমস্যা হবে। 

Plagiarism মূলত বেশি করে উপমহাদেশের ছেলেমেয়েরা। কারন আমাদের আন্ডারগ্র্যাডের রিপোর্ট জমা দেয়াটা ছিল অনেকটা নেভার মাইন্ড টাইপের। আমরা মুখস্থ করার জন্য যে শ্রমটুকু দেই, মাথা খাটিয়ে লেখার ব্যাপারে সেই শ্রমটুকু দেইনা। ছোটবেলা থেকে আমাদের Plagiarism এর শিক্ষাটাও তেমনভাবে দেয়া হয়না বা এর জন্য আমাদের শাস্তি বেশ কম পেতে হয়। আমেরিকার ছেলেমেয়েরা এই কাজটা একটু কম করে।মনে রাখবেন, Plagiarism যদি করেন, আজ হোক কাল হোক আপনার ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। অতএব, সাধু সাবধান।

শেষ কথা হলো, চুরিবিদ্যা করে ধরা পড়লে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেশ খবরই আছে। তার আগে সতর্ক থাকাটা বেশ জরুরী। মুহুর্তের মধ্যে আপনার ক্যারিয়ার ধবংস হয়ে যেতে পারে শুধুমাত্র plagiarism এ ধরা পড়ার কারনে। আমার এই লেখাটা পড়ে অন্তত একজন ছাত্রও যদি সাবধান হতে পারেন তাহলে সেটাই আমার জন্য অনেক পাওয়া। 

ঢাবির পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণা চুরির অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তিন বিভাগের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের গবেষণাপত্রে লেখা চুরির অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ভিন্ন দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটিকে চার সপ্তাহ সময় বেধে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। ২৭ সেপ্টেম্বর বুধবার এক সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে লেখাচুরির অভিযোগ আনা হয় ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং ক্রিমিনোলজি বা অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ এর অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে।

চিঠিতে বলা হয়, এই দুইজন শিক্ষক ফ্রান্স দার্শনিক মাইকেল ফৌকাল্টের একটি লেখা কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে চুরি করেছেন। ওই দার্শনিকের মূল লেখার শিরোনাম ছিল ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ যা ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির দাবি ঢাবি শিক্ষার্থীদের। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় নকল করে ধরা খেলে এক/দুই বছর বহিষ্কার হন। তাহলে শিক্ষকরা কেন হবেন না। 

সম্পাদনাঃ আব্দুল্লাহ শাহীন 

এমএসএল