এভাবেই নিস্তব্দ হয়ে যাচ্ছে ঢাবির প্রাণবন্ত আড্ডার পরিবেশ


আমিনুল আনন্দ | Published: 2017-10-22 06:53:06 BdST | Updated: 2024-05-11 16:06:48 BdST

শোনেন বাবারা(কচিকাচা), আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে আছিলাম তখন সব জায়গায় আড্ডা বসত। শুধু টিএসসি না পুরা ইউনিভার্সিটি জুইড়া আড্ডা বসত। মহসিন হলের ভিতরের দোকান গুলাতে বান্ধবিগো সাথে নুডলস খাইতে জাইতাম। নুডলস খাইতাম আর পেচাল পারতাম। আজাইরা পেচাল। ফ্যাকাল্টির অনেক পোলাপান যাইত ওইখানে। প্রিন্ট করাইতে, কেলাসের ফাকে হাল্কা খাবার খাইতে। টুকটাক কথা হইতে হইতে আড্ডা জইমা গেছিল।  যেই হলের ভিতরে দোকানগুলা ঢুকলো, আমাগো আড্ডাও ফুরোলো। কিচ্ছু করার নাই। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ।

বসুনিয়া চত্বরে চা, সিংগাড়ার দোকান আছিল। খেলতে খেলতে চামে দিয়া আইসা দুইডা সামুচা আর পানি খাইয়া নতুন উদ্যমে খেলায় ঝাপায়া পড়তাম। সামুচা চিবাইতে চিবাইতে দেখতাম আরোওনেক পোলাপান। ফার্স্ট ইয়ার? কোন ডিপার্টমেন্ট? এম্নে কথা শুরু হইত, শেষ হইত একসাথে খেইলা। আর এখন? এখন দোকানগুলা ভাইংগা দিছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে।

আমাগো হলের টিভি ছিল ছোডু। ২১ ইঞ্চিতে পোষাইত না। ভাই বেরাদার মিইলা জসীম উদ্দিন হলে খেলা দেখতে যাইতাম। অইখানে বিশাল একখান টিভি আছিল। খেলার আগে একদফা আড্ডা দিতে দিতে দোকানগুলাতে খাইতাম। আবার এল ক্লাসিকো, ইউসিএল এর ফাইনালের মাঝখানের বিরতিতে ধুম কইরা বাইর হইয়া বড় ভাইগো পচানি খাইতে খাইতে রিয়ালের প্লেয়ারদের গুস্টি উদ্ধার করতে করতে ধুপ ধাপ চা-মিস্টি খাইয়া মনের সব রাগ বড় ভাইগো বিলের উপর ঝাইড়া আবার খেলা দেখতে ঢুকতাম। একদিন হঠাৎ কইরা শুনি, কর্তৃপক্ষ ১১ তার মইধ্যে দোকান বন্ধ করার নোটিশ দিছে। এখন যেইটা টাইনা টুইনা ১২.৩০ পর্যন্ত যায়। জসীমউদ্দিনে যাওয়া বন্ধ হইয়া গেল ছবির হাট বইলা একটা জায়গা আছিল। ঐটার পাশেই দুপুরের খাওন পাওয়া যাইত। মোল্লা নামে পরিচিত আছিল। ছবির হাট গম গম করত। বিচিত্র ধরনের লোকজন একজায়গায় বইসা গপ্পো করত। সেইডাও দেখি একদিন নাই হইয়া গেল।

ফুলার রোডে নিয়ন আলোর নিচে বইসা আড্ডা দিতাম,গান গাইতাম। অদ্ভুত এক মায়াকারা পরিবেশ ছিল অইডা। গলার আওয়াজের চড়ার পাশাপাশি পাল্লা দিয়া বাড়ত মিরিন্ডার খালি বোতল। এক সন্ধায় আইসা দেখি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দোকান দুইডা গুরায়া দিছে। শুকনো গলায় আর কতক্ষন গান গাওয়া যায়। সেই জায়গাও আস্তে আস্তে ফাকা হইয়া গেল
জিয়া হলের সামনে বেশকয়েকটা চা এর দোকান আছিল। মধুদা, জালাল মিয়ার আগুন চা খাইতে খাইতে দেশ, রাজনীতি নিয়া জ্বালাময়ী আলোচনা চলত। জিয়া হল, বংবন্ধু হল, জসীম উদ্দিন হল, সুর্যসেনের পোলাপানে সব সময় ঠাসা থাকত জায়গাডা। সমবয়সী/বড়/ছোট অনেকর সাথে পরিচয় হইছে এই জায়গায়। এর পর যোগ হইল বিজয় একাত্তর। একদিন সকালে উইঠা দেখি দোকানগুলা একটাও নাই। কর্তৃপক্ষ সরাইয়া দিছে।

যারা একটু নিরিবিলি পছন্দ করত, তাগো লাইগা টিএসসি ধইরা একটু সামনে আগাইলেই কারাসে নুরু মামা চা নিয়া বইসা থাকত। কত দুপুর-সন্ধ্যা-বিকাল পার হইছে এইখানে! এইখানে একটা আড্ডা বসত। কিছু সিনিয়র আইত। কিছু মানুশের নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল এইডা। মাঝখানে নুরুমামা অনেকদিন অসুস্থ ছিল। তারপরেও ঐখানে যায়া বইসা থাকতাম পরিচিত মানুষগুলার সাথে একটু হাউস মিটায়া কথা কওনের লাইগা।

তার একটু সামনে আগালেই পরমানুর সামনে আজমেরি ভাই এর দোকান থিকা চেয়ার নিয়া রাজকীয় ভাবে বইসা চায়ে চুমুক দিতাম আর বন্ধুগো লাইগা অপেক্ষা করতাম। খালি চায়ের কাপ ফেরত দিলে জিগাইত, আরেক কাপ দিমু নাকি??
কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আজমেরী ভাই তল্পিতল্পা সহ নাই। নুরু মামা পলানটুক পলানটুক খেলে। আজ বসে তো কাল বসে না।
প্যারি গল্পে অন্নদাশ শংকর(আমি খুবই খারাপ ছাত্র। ভুল হইলে মাফ কইরা দিয়েন) বলেছেন, প্যারিস নগরি গড়ে উঠেছে প্যারিসের অলিগলির ক্যাফের আড্ডায়। এইযে আড্ডার কথা কইলাম। কি হয় আমগো এই আড্ডায়? উত্তরঃ কথা হয়। দেশ নিয়া হয়, বিদেশ নিয়া হয়, খেলা নিয়া হয়, চলচিত্র নিয়া হয়, কার জীবন দর্শন কি রকম সেইটা নিয়া হয়, কোন ব্যাটা কবে কি আবিষ্কার করছে সেইটা নিয়া আলোচনা হয়। সৌম্য সরকার দলে থাকবে কি না সেইটা নিয়া তর্ক শুরু হয়ে আইএস এর আসল পরিচয় কি হয়ে, বিসিএস দেয়া ভাল না খারাপ হয়ে, ফুকো কি কইছে সেইটার ব্যাখা বিশ্লেষন কইরা শেষ হয় অঞ্জন দত্তের মালা গান দিয়া।

কোন ঠিকঠিকানা নাই। বিজনেস ফ্যাকাল্টির ছাত্র হিসেবে বেশিরভাগ-ই মাথার উপর দিয়া যায়। কলেজের স্যার কইছিল, ডিপার্টমেন্ট একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা গড়ে তুলবে। কিন্তু অন্যলোকজনের সাথে মিশলে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি সুপ্রসারিত হবে, জীবনবোধ গড়ে উঠবে। চেস্টায় আছি জীবনবোধ গড়ে তুলতে এইযে এত্তগুলা আড্ডার কথা কইলাম, শেষ আশ্রয়স্থল হইল টিএসসি। ৭/৮ বছরের সিনইয়র ব্যাচের ভাই/আপুরা আসে। তাদের জীবনের গল্প শুনি, নিজেদের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি। কত বিনিদ্র দিবস-রজনী কাটছে এই জায়গায়! সব জায়গা শেষ। টিকে আছে শুধুমাত্র এই জায়গাডা। এখন সেইটা নিয়াও খেলা শুরু হইছে।

বাবারা, এইযে একটার পর একটা জায়গা বন্ধ হইয়া যাইতেছে, এই কাজগুলা একদিনে হয় নাই। আস্তে আস্তে হইছে। জাল অনেকদিন আগেইই ফেলা হইছে। এখন আস্তে আস্তে টানতেছে। লাস্ট টান টিএসসি। এইযে আপ্নেরা কচিকাচারা, এখন বলতেছেন ৮ টায় বন্ধ হইলে অসুবিধা কি? আপনার ২ ব্যাচ জুনিয়র আইসা বলবে ৬ টায় বন্ধ হইলে অসুবিধা কি?
দড়িতে টান পরছে। জাল গুটানোর আগেই যা করার কইরেন। একবার জালে আটকা পরলে পরে সুবিধা করতে পারবেন না তারা হাতে মারবে না, ভাতে মারবে। তারা ডিরেক্ট বলবে না এইখানে বসা যাবে না, বসার যায়গায় হাইগা রাইখা যাইব যাতে আপ্নেরা ঐ জায়গায় না বসেন।
কি_বুঝেন_নাই_ব্যাপারটা?

 লেখাটি আমিনুল আনন্দের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া

এমএসএল/ ২২ অক্টোবর ২০১৭