ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হবে: বামদের ইশতেহার আসছে


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2018-12-03 10:37:27 BdST | Updated: 2024-07-08 03:15:54 BdST

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করবে বাম গণতান্ত্রিক জোট। একইসঙ্গে দল-মত নির্বিশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার বিধান সংবিধানে ফেরানোসহ প্রায় ৩১ দফা নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রেখে নির্বাচনি ইশতেহার তৈরি করেছে ৮টি বাম দলের এই জোট। সোমবার (৩ ডিসেম্বর) জোটের ইশতেহার কমিটির বৈঠকে খসড়া ইশতেহার চূড়ান্ত করা হবে। ৭ বা ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইশতেহার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে বামজোট।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের খসড়া ইশতেহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬ হাজারেরও বেশি শব্দে বিস্তারিত ইশতেহার তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে সংক্ষিপ্তরূপে একটি ইশতেহার কপিও তৈরি করবে বামজোট। ‘গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়, দুর্নীতি-লুটপাট-দলীয়করণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও জনদুর্ভোগ লাঘব, ধনী-গরিবের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে: মহাজোট-জোটের বাইরে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তুলুন’ শীর্ষক স্লোগানে ইশতেহার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বামজোটের ইশতেহার প্রায় চূড়ান্ত। সোমবার সকালে ইশতেহার কমিটি বসবে। আশা করছি, কালই চূড়ান্ত হবে। এরপর আমরা সপ্তাহান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবো।’

বামজোটের ইশতেহার তৈরির কাজে নিযুক্ত দায়িত্বশীল নেতারা জানান, নির্বাচনি ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধান ও রাজনীতির সংস্কার করা হবে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা, সশস্ত্র বাহিনীর সব কার্যক্রম জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখা, ঘুষ-দুর্নীতি-বন্ধুকযুদ্ধবন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বেতার-টিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি থাকছে বামজোটের ইশতেহারে।

ইশতেহারের ভূমিকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা, প্রহসনের নির্বাচনের পাঁচ বছর পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের এক সার্বিক ও গভীর সংকটের প্রেক্ষাপটে অবশেষে বহু প্রত্যাশিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৯০-এর দশকের শুরুতে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে গণতন্ত্র বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু গত ২৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতকেন্দ্রিক সরকার পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তারা দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিধি-বিধান-নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ কার্যকর করতে পারেনি।’

ভূমিকার এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘বাতিল করার সব সুযোগ থাকার পরও সরকার সংবিধানের ২য় ও ৮ম সংশোধনী, প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর সব অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাবিরোধী ধারা ও সংশোধনীগুলো বহাল রেখেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও চরিত্র বিপজ্জনকভাবে প্রসারিত হচ্ছে।’

খসড়া ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনি অঙ্গীকার হিসেবে ৩১ দফা কর্মসূচি দেশবাসীর সামনে উত্থাপন করছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংসদে ও সংসদের বাইরে সর্বাত্মক প্রয়াস চালানোর দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।’

ইশতেহারের ৩১ দফায় বলা হয়েছে—মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতির সংস্কার সাধন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনসহ জোটের ৫৪ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন, ধনী-গরিব বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া ও চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করা। ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-দুর্বৃত্তায়ন-মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। কৃষি, কৃষক, গ্রামীণ মজুরের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়ন। দেশীয় শিল্পের বিকাশ, শ্রমিক ও কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়ন। শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়ন। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করা। শিক্ষাখাতে পর্যায়ক্রমে জাতীয় আয়ের ৮% বরাদ্দ কর। স্বাস্থ্যখাত ও চিকিৎসার মানোন্নয়ন। চিকিৎসা বাণিজ্য বন্ধ করা। চিকিৎসা বাজেট বৃদ্ধি করা। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে উন্নতমানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কাঠামো গড়ে তোলা। যুবসমাজের তারুণ্য-সম্পদকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ-দুঃস্থ নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য রোধ এবং তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। বিভিন্ন জাতিসত্তা, আদিবাসী সমাজ ও দলিতদের যথাযথ স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। শহরের বস্তিবাসী, হকার ও নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন। প্রতিবন্ধীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি ও অধিকার রক্ষা। তথ্য-প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমকে সর্বজনীন করা। প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু রক্ষা। পৃথিবীর উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করা। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও বিকল্প জ্বালানিনীতির বাস্তবায়ন। পানি উন্নয়ন ও বন্যা সমস্যার প্রতিকার। দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, যোগাযোগ-ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, যানজট রোধ। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত পরিবহন ব্যবস্থা দ্রুত বৃদ্ধি করা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। মাদক ও পণ্যছবি নিয়ন্ত্রণ করা। ক্রীড়া, শরীরচর্চা ও বিনোদনের সুযোগ নিশ্চিত করা। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা।

এই ৩১টি দফার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে ইশতেহারে। প্রথম দফার উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানের সাংঘর্ষিক সব বিধিবিধান বাতিল করা।

বামজোটের ইশতেহারে জোর দেওয়া হয়েছে মানুষের বাকস্বাধীনতার ওপর। প্রতিশ্রুতিপর্বে বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’সহ মৌলিক অধিকার খর্বকারী সব নিবর্তনমূলক কালা-কানুন বাতিল করা হবে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গণ-প্রচারমাধ্যমসমূহের ওপর জনগণের কার্যকর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাসহ বেতার-টিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ইশতেহারে প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছে, ‘দেশ রক্ষার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে সব সক্ষম তরুণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাসহ যুগোপযোগী প্রতিরক্ষানীতি তৈরি করা হবে। দেশের প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ ও সশস্ত্র বাহিনীর সব কার্যক্রম জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদিসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’নীতি গ্রহণ করা।

গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে (১) উপযুক্ত গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, (২) স্বচ্ছতা, (৩) জবাবদিহিতা, (৪) জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ—এসব মূলনীতির ভিত্তিতে মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানোর কথাও উল্লেখ করা হয়। বামজোটের ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয়, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা উল্লেখ করা হয়ে নির্বাচনি ইশতেহারে।

শ্রমিকদের বেতন ১৬ হাজারে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে বামদের ইশতেহারে। বলা হয়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মিল রেখে মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা চালু করা এবং মজুরি কাঠামো প্রতি ২ বছর অন্তর পুনর্বিন্যাস করা হবে ।

শিক্ষাক্ষেত্রে রয়েছে বামজোটের বাড়তি মনোযোগ। খসড়া ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘৩ বছরের মধ্যে প্রতি ২ বর্গকিলোমিটারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৮ বছরের মধ্যে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।’

নারীদের ক্ষেত্রে বামদের ইশতেহারের এক জায়গায় প্রতিশ্রুতি থাকছে, ‘নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ফতোয়াকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করে ২০০১ সালে হাইকোর্ট-প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়কে কার্যকর করা হবে।’

স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি থাকবে ইশতেহারে। এছাড়া স্থায়ী বিশ্বশান্তি ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য দৃঢ় ও সক্রিয় প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়টিও যুক্ত থাকবে।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, বাম গণতান্ত্রিক জোট জিন্দাবাদ’ শীর্ষক স্লোগানের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি ইশতেহারের সমাপ্তি টানবে বাম গণতান্ত্রিক জোট।--বাংলা ট্রিবিউন