নিজস্ব প্রতিবেদক
‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার এখনই সময়’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২৪’। প্রতিবছরের ১০ অক্টোবর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। এ দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ ও বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি (বিসিপিএস) সম্প্রতি একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এ ওয়েবিনারে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সরকারি ডিএনএ ল্যাবের মহাপরিচালক ডা. এ এম পারভেজ রহীম, স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম আবু হানিফ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ডক্টর মো. আখতার হোসেন খান।
কি-নোট স্পিকার হিসেবে ওয়েবিনারে অংশ নেন ঢাবির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিসিপিএসের সভাপতি ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তাদের সেবা প্রদান করা অনেক জরুরি। আমরা দেখতে পাই মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজন আছে এমন মানুষদের মধ্যে মাত্র ৮ ভাগ মানুষ সেবা নিতে পারছেন, ৯২ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বাইরে রয়ে যান। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে আমাদের দেশে যে রিসোর্চের ঘাটতি আছে তা এতেই স্পষ্ট হয়। একইসঙ্গে যদি শিশু-তরুণদের চিত্র দেখি তাদের মধ্যে চিকিৎসা ঘাটতির পরিমাণ ৯৪ শতাংশ, মাত্র ৬ শতাংশ চিকিৎসা নিতে পারছেন।
তিনি বলেন, আমরা কর্মক্ষেত্রকে চিন্তা করি আর্থিক নিরাপত্তার বিবেচনায়, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এতটা গুরুত্ব পায় না। মানসিক স্বাস্থ্য একটি স্টেট অব ওয়েল বিং, যেখানে আমরা জীবনকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নেই, কীভাবে আমাদের অ্যাবিলিটিগুলোকে ব্যবহার করি, কীভাবে আমরা শিখি, শেখাটাকে কাজে প্রয়োগ করি এবং কীভাবে আমরা চারপাশের কমিউনিটিতে অবদান রাখি এই সব বিষয়গুলোই মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমাদের চারপাশের কমিউনিটিতে অবদান রাখতে, সামগ্রিক বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সম্পর্কগুলোকে জোরালো করতে এবং বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা গেলে সেটা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারাবিশ্বে ৬০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে ১৬ শতাংশের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা এসেছে তা হলো- অতিরিক্ত কাজের চাপ, যা একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কর্মক্ষেত্রের বাইরে এই ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
তিনি আরও বলেন, গবেষণা বলছে যদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে ১ ডলার বিনিয়োগ করা হয় তবে রিটার্ন আসে ৪ ডলার। খুবই সহজ একটি ব্যবসা। আপনি ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ৪০০ টাকা রিটার্ন পাবেন। এরচেয়ে সহজ ব্যবসা আর কী আছে! কিন্তু তারপরও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হচ্ছে না।
নিউরোসাইকোলজি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এমএম জালাল উদ্দীন বলেন, আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগী সার্বিক স্বাস্থ্য খাতের ১৩-১৪ শতাংশ। অথচ এর বিপরীতে বাজেট মাত্র ০.৫ শতাংশ। সুতরাং আমাদের রিসোর্চের যেমন ঘাটতি আছে আমাদের বাজেটেরও ঘাটতি আছে।
ওয়েবিনারে ঢাবির নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তি উদ্যোগের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন। কেননা পরিবেশ থাকলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে প্রতিষ্ঠান যদি সেটি নিশ্চিত করতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যাহত করে এমন ঘটনা যদি বন্ধ করা যায় তাহলেই কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
আইইউবিএটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, কর্মস্থলে এমন নীতিমালা থাকতে হবে, যাতে কর্মীরা বৈষম্যের শিকার না হন। যাতে কর্তৃত্বের ভারসাম্য থাকে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. জহির উদ্দিন বলেন, কর্মক্ষেত্রে একটি বৈষম্যহীন পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। কর্মীর যাতে মনে না হয় তার সাথে যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে। কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে যাতে মূল্যায়ন হয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন ঢাবির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিসিপিএসের সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ শাহানূর হোসেন। সরকারি জরিপের সর্বশেষ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। এর মধ্যে ডিপ্রেশন অ্যাংজাইটি, সোমাটাইজেশন ডিসঅর্ডার এগুলো মিলিয়ে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বাকিগুলো অন্যান্য ডিসঅর্ডারের মধ্যে পড়ে। এতে স্পষ্ট যে, ডিপ্রেসন অ্যাংজাইটি, সোমাটাইজেশন ডিসঅর্ডার বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রধান মানসিক সমস্যা। এছাড়া ১২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা আছে।
তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে এম.এস, এম.ফিল থিসিস মিলিয়ে প্রতিবছরই ২৫/৩৫টি গবেষণা হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের সরকারি জরিপের তুলনায় তিনগুন বেশি মানুষ মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। একটা হলো অসুস্থতা আরেকটি হলো তীব্র লেভেলের মানসিক সমস্যা যারা মনে করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নেয়া প্রয়োজন। এ রকমের মানুষের মধ্যে দেখেছি প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের মধ্যে মডারেট-২ সিভিয়ার লেভেলের অ্যাংজাইটি কাজ করে এবং এটি তাদের প্রাত্যাহিক জীবনকে প্রভাবিত করে। এছাড়া প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন আছে। এই যে একটা বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে তারা সবাই যে সেবা নিতে পারেন বা সেবা নিতে আসেন তা কিন্তু নয়। এর একটি বড় কারণ হলো, আমাদের দেশে যে প্রফেশনাল গ্রুপ যারা এই মানুষগুলোকে সেবা দিবেন তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। যেমন- আমরা যদি এমবিবিএস ডাক্তারদের লেভেল থেকে দেখি, বাংলাদেশে প্রতি ১ লক্ষ রোগীর জন্য মাত্র ১৩ জন চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে মানসিক সেবা প্রদানের জন্য প্রতি ১ লক্ষ রোগীর বিপরীতে নিউরোলজিস্ট আছেন ০.১ শতাংশ, সাইকিয়াট্রিস্ট ০.২ শতাংশ এবং সাইকোলজিস্ট (প্রশিক্ষণার্থী থেকে প্রশিক্ষিত মিলিয়ে) আছেন ০.৫ শতাংশ। সুতরাং এত বড় একটি অংশ যেখানে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তারা ঠিকভাবে সেবা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে এই মানুষগুলো চিকিৎসা সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
ড. শাহানূর হোসেন বলেন, আমরা জরিপে দেখেছি প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯০ শতাংশ শিশু মানসিক সমস্যায় আছেন যারা মানসিক চিকিৎসা সেবার সুযোগ পাচ্ছেন না, বা পেলেও অনেক ব্যয়বহুল যে কারণে সেখানে যাচ্ছেন না। এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রফেশনাল গ্রুপ ও ডিপার্টমেন্ট কাজ করছে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা একবার একটা হিসাব করে দেখেছি যে, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বা সাইকিয়াট্রি এ ধরনের স্পেশালাইজড প্রফেশনাল গ্রুপ যারা মেন্টাল হেলথ এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেন তাদেরকে তৈরি করা একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার। প্রায় ৩-৪ বছরের পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০০-৬০০ জন সাইকোলজিস্ট আছেন যারা কাজ করছেন, যেখানে প্রয়োজন ৫০ হাজারের অধিক। এই মানুষকে যদি আমরা ট্রেনিং দিয়ে চিকিৎসা সেবা বাড়াতে চাই, রোগীর বিপরীতে এক্সপার্টদের গ্যাপ কমাতে চাই সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি কাজ করতে শুরু করে তাতেও এই গ্যাপ পূরণ করতে ২০ বছর সময় লাগবে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে আমাদের এ খাত নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হবে, এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে কমান্ডিং ভয়েজটা চেঞ্জ করে সহকর্মীর সমস্যা বোঝা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসন ডা. এবিএম আবু হানিফ। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সৃষ্ট পদে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের পোস্টগুলো কেন শূন্য হয়ে আছে, সেটা আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালেও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করা হবে। পলিসি মেকারদের যুক্ত করে এই খাতে বাজেটের বিষয়টাও খতিয়ে দেখার তাগিদ দেন তিনি।
ওয়েবিনারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিশু নিহতের ঘটনা স্মরণ করেন সরকারি ডিএনএ ল্যাবের মহাপরিচালক ডা. এ এম পারভেজ রহিম। পরিবারে মেন্টাল ট্রমা কতটা কষ্টের তা উল্লেখ করে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হয় তাহলে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছর আত্মহত্যায় অনেক বড় অংশের মানুষ মারা যায়।
ডা. এ এম পারভেজ রহিম জানান, উপজেলা লেভেলে মেন্টাল হেলথ সেবা এখনও জিরো পর্যায়ে আছে। ১৮ কোটি মানুষকে সেবা দিতে ৫ হাজার প্রশিক্ষিত পেশাজীবী দরকার। হাসপাতালে সাইকোলজিস্টদের রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে। তড়িৎ গতিতে এই প্রসেস করতে হবে। তা না হলে মেডিক্যাল এবং নন-মেডিক্যাল প্রফেশনালদের মাঝে বৈষম্য রয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
ওয়েবিনারে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা অংশ নেন। যা দুই ঘণ্টাব্যাপী চলে।