১৯০৫ সালের বঙ্গঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের মাঝে যে নবজাগরণ ঘটে তারই ফল স্বরুপ ১৯২১ সালের ১জুলাই ৩টি অনুষদ, ১২ টি বিভাগ , ৬০ জন শিক্ষক,৮৭৭ জন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ৩ টি হল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।যা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিণত হয় এবং পূ্র্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তির প্রতিটি আন্দোলনে জাতি কে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল তৎকালীন সময়ের অবহেলিত মুসলিম সমাজের জাগরণের এক অনন্য মাইলস্টোন। সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দেখা দিলেও পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় হতেই এমন সকল নেতৃত্ব গড়ে ওঠে যারা সরাসরি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং মুসলমানদের একক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ জন্ম ও বিকাশের সাথে জড়িত এবং প্রত্যক্ষ্য ভাবে এই ভুখন্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয় । তাদের মাঝে বলতেই হয় , বৃটিশ বিরোধী বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর
বাংলার বাঘ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী । বাংলার স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলেরই একজন শিক্ষার্থী ।
ইতিহাসে যে ঘটনাকে বাঙ্গালী জাতিসত্তার রেনেসা বা পুনর্জাগরণ বলা হয় সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মহান নায়কেরাও ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী । তাদের মধ্যে আবুল কাশেম , অলি আহমেদ, নুরুল হক ভু্ইয়াঁ , কামরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। উল্লেখ্যা ,১৯৪৮ সালে ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন ,”উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” । শিক্ষার্থীরা তৎক্ষণাৎ “না না” বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী সহ ভাষা আন্দোলনের হেডকোয়ার্টার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে যে ছাত্রটি নুরুল আমিনকে নির্বাচনী ভোটে পরাজিত করেছিল সেও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ।বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ৬দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী । এমনকি ৬ দফা এবং ১১দফার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক,শেখ শহিদুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী,শেখ ফজলুল হক সহ তোফায়েল আহমেদ এর মত কিংবদন্তী ছাত্রনেতা ;সকলেই ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ।
১৯৬৯ এর ৪ ঠা জানুয়ারী গণঅভ্যুথ্থানের মহা হাতিয়ার হিসেবে যে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় তাকেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন ডাকুসু(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) এর নেতৃবৃন্দ।
১৯৭১ সালের ২মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনেই ছাত্র জনতার এক বিশাল সমাবেশে প্রথমবারের মত উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের পতাকা ।পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সমগ্রামের হেড কোয়ার্টার তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল জনগণের ক্যান্টনমেন্টে । এজন্য ২৫শে মার্চের কাল রাতে বিশেষ ভাবে টার্গেট করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় কে ।সেদিন (২৫শে মার্চ রাত) প্রথম রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তারা হত্যা করে। তারা প্রথমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল (সূর্যসেন হল) ও জগন্নাথ হলে আক্রমণ চালায় এবং বেশ কয়েকজন ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হত্যা করে। তারা কলা ভবনের সামনের বটগাছটি উপড়ে ফেলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রাদি পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয়।সেদিন পাক বাহিনীর আক্রমণে নিহতদের মধ্যে যাদের নাম পরিচয় পাওয়া যায় তাদের মধ্যে শিক্ষক রয়েছে ১৯ জন, ছাত্র ১০১ জন, কর্মকর্তা একজন ও কর্মচারী ২৮ জন।
তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদেরও অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থী।
ছাত্র রাজনীতির আতুঁঘর হিসেবে খ্যাত মধুদার স্মৃতি বিজরিত মধুর ক্যান্টিন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্যতন প্রাণভ্রমরা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রজাত্রা কে ফিরিয়ে আনতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নেতৃ বৃন্দ।
শুধু স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী নয় ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় নিজেকে শিল্প-সংস্কৃতি শিক্ষা চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে দেশ মাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা রেখে প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিটি পদক্ষেপে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী -শিক্ষক সমাজ নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে আর নেতৃত্ব দিয়েছে গোটা জাতিকে ।
জনগণের ক্যান্টনমেন্ট খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রত্যাশা থাকবে নিছক প্রতিবন্ধকতা কে মুছে ফেলে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরো স্বপ্নময় হবে আর ইতিহাসের এই জীবন্ত যাদুঘরে যুক্ত হবে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখার গৌরবময় সব গল্প।
পরিশেষে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস।
লেখকঃ
সামসুল আরেফিন সেজান
নির্বাচিত সদস্য, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ