বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের জয় বাংলা


Dhaka | Published: 2020-09-11 01:12:40 BdST | Updated: 2024-06-29 11:30:24 BdST

১৯৭১ বাঙালি জাতির অমলিন যুগচিহ্ন। স্বাধীনতা তার সোনালি ফসল। হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ধাবমান শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছিল এই বঙ্গ। ‘জয় বাংলা’ শব্দটি প্রথম কে বলেছিলেন? কী তাঁর পরিচয়?

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, গানের কবি, মানবতার কবি, বাঙালির স্বাধিকারের কবি নজরুল ইসলামই প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি লিখেছিলেন। আর আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ‘জয় বাংলা’ শব্দটিকে শানিত অস্ত্রের মত ব্যবহার করেছিলেন। আপামর জনতা বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। শহীদ হয়েছিল আমার ভাইয়েরা, বোনেরা হারিয়েছিল সম্ভ্রম। হাজারো ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে এই বাংলার বুকে উড়ছে জয় বাংলার লাল-সবুজ পতাকা।

এ স্বাধীনতার সাথে যারা যুক্ত—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য জাতীয় নেতা, যারা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন—সবার প্রতি রইলো অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক-হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ডাক দেন।

বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ইংরেজিতে ঘোষণার এই স্বাধীনতার বাংলা অনুবাদ হলো, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকেও বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ...আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুক। জয় বাংলা।’

তারই ধারাবাহিকতায় ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দ্বিতীয় বারের মত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ‘...ডিক্লেয়ার দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ। অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেড ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ এ ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার, তৎকালীন ইপিআই এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।

১৯৭১ সালের সেই দিনটি ছিল বাঙালির জীবনের দীর্ঘ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এক সন্ধিক্ষণ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় সেদিনই। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রায় ২০০ বছর অপেক্ষায় ভারত উপমহাদেশের জনগণ পায় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সর্বক্ষেত্রেই তাদের অধিকার বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি পায় নতুন সময়ের এক দিক-নির্দেশনা।

মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালিকে নিয়ে যায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পথে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয় লাভ, ছাপ্পান্নর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন। আটান্নোর মার্শাল ল’বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন—সবই বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক।

কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা বাঙালির এ অর্জনের স্বীকৃতি দিতে নারাজ। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি সময় কারাভোগ, মিথ্যা মামলায় বহুবার কারাবরণ সত্ত্বেও এ দেশের মানুষের স্বাধীকার অর্জনে বটবৃক্ষের মতো ভূমিকা পালন করে। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাময় ঐতিহাসিক নির্দেশনা, যার পরতে পরতে ছিল মানুষের উজ্জীবিত হওয়ার এক বীজমন্ত্র। এ ভাষণ শোনামাত্রই প্রতিটি মানুষের অন্তরে-অনুভবে সৃষ্টি করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীকারের এক তীব্র প্রেরণা। ৭ মার্চের প্লাটফর্ম ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের এক দার্শনিক, বাস্তবিক দিক-নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু এ দীর্ঘ অভিযাত্রায় যার দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রাণীত হন; তিনি হলেন বাঙালির স্বাধীনতার আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। ‘বল বীর—/বল উন্নত মম শির।/শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)। নজরুল ‘বিদ্রোহী’র উপসংহারে লেখেন, ‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/যবে, উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’

বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে যাদের নাম অপরিহার্যভাবেই চলে আসে, তাঁরা হলেন—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী নজরুল ইসলাম। এ দুই মহাপ্রাণের জন্ম না হলে বাঙালি পেত না তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দু’জনের বয়সের সংখ্যাগত পার্থক্য ২১ বছর। দু’জনের জীবনের বাস্তবতা হলো, নজরুল যখন সৃষ্টিকর্মে উদীয়মান; বঙ্গবন্ধুর তখন জন্ম। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যখন আন্দোলনের তুঙ্গে; তখন নজরুল নিভে যাওয়া এক আগ্নেয়গিরি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে সমান্তরাল অবস্থানে রয়েছেন। (বাংলানিউজ, ২৫ মে ২০১২)

তিনি অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া। নজরুলও চেয়েছেন বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে। দু’জনের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। দু’জনই ছিলেন বিদ্রোহী। একজন-সাহিত্যে, অন্যজন রাজনীতিতে। এ জন্য একজনকে বলা হয় ‘পোয়েট অব লিটারেচার’, অন্যজনকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’।

‘জয় বাংলা’ অভিধাটির একটি ঐতিহাসিক পরিক্রমা রয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, সুরমা-ধলেশ্বরী-কর্ণফুলী, আরও কত নদ-নদী বাহিত, পলিগঠিত এই বঙ্গীয় অববাহিকা। অনাদীকাল থেকেই এই ব-দ্বীপ ভূমিতে বিবর্তমান মানবগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্রসূচক অভিধার নাম বাঙালি। আর তার বসতভূমির নাম বাংলা নামের দেশ। (মুহাম্মদ নুরুল হুদা, নজরুলের ‘জয় বাংলা’)। ঐতিহাসিক পরিক্রমায় দেখা যায়, বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত দলিল ‘চর্যাপদে’ কবি ভুসুকুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘বাঙালি’ অভিধাটি। মধ্যযুগের মুসলমান কবি আবদুল হাকিমের কণ্ঠে তীব্র শ্লেষাত্মক উক্তি, ‘যে সবে বঙ্গতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এভাবে বহু কবির রচনায় ‘বাঙালি’ প্রসঙ্গটি আসে নানা মাত্রিকতায়।

আসলে বাঙালি কবির কাছে বাঙালি ও বাংলার জয়গান মানে তার সনাক্তকৃত স্ব-সত্ত্বার স্বাধীনতার গান। (সূত্র: ঐ)। এ পথ ধরেই বাঙালি পেয়েছে তার দুইশত বছরের হারানো স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর মোট নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে এ বাংলা পায় সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। বলা যায়, হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় ‘বাঙালি’ এই অভিধা স্বত্ব: প্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করে।

‘জয় বাংলা’ অভিধাটি আক্ষরিক অর্থে নজরুলই প্রথম ব্যবহার করেন তাঁর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাটিতে। কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ভাঙ্গার গান’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই গ্রন্থটি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। কবিতাটির পরতে পরতে ছিল বাংলার ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির পাশাপাশি বাঙালির ভবিষ্যত মুক্তিযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের ইঙ্গিত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শেষ সংলাপটি ছিল—‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ জয় বাংলা।’ কবিতাটি প্রকাশের ৪৭ বছরের মাথায় এরই বাস্তবায়ন ঘটে এই বাংলায়। নজরুল কবিতাটি লেখার পর বৃটিশ সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করে দেয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার কয়েকদিন পর ২৬ মার্চ তাঁকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে ফেলে। একজন বাঙালি কবি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে, অন্যজন রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

১৯৪২ সালে ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন—‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও-‘এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালির-আমাদের।/দিয়া ‘প্রহারণে ধনঞ্জয়’/তাড়াব আমরা, করি না ভয়/যত পরদেশী, দস্যু ডাকাত/রামা-দের গামা-দের’। বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক। (মাহমুদুল বাসার, সিরাজদৌলা থেকে শেখ মুজিব, পৃ: ৮৬-৮৭)

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নজরুলকে ভারতবর্ষ থেকে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। দেশ পুনর্গঠনের অন্যতম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে নজরুলকে বাংলাদেশে এনে তাঁর ৭৩তম জন্মদিবস পালনের উদ্যোগ ছিল মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধু নজরুলকে ভালোবাসতেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর কাব্যের প্রতি তিনি আসক্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে নজরুলের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি তিনি যাকে উদ্দেশ্য করে রচনা করেন। অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্র, তাঁর চেতনা-আদর্শের প্রতিও বঙ্গবন্ধু আসক্ত হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই নজরুল রচনাবলী পাঠ করতেন। তাঁর প্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—‘নম: নম: নম: বাংলাদেশ মম/চির-মনোহর চির মধুর/বুকে নিরবধি বহে শত নদী/চরণে জলধির বাজে নুপূর’। (নজরুল সংগীত সম্ভার, পৃ-১৩৭)

বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে বিদ্রোহী কবি নজরুল ও বিদ্রোহী নেতা বঙ্গবন্ধু দু’জনই চেতনায় ছিলেন এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লেখেন—‘তাঁর জীবনে জনগণই ছিল অন্তঃপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে-হাঁসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন—এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ-আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবী আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল করেছেন।’

বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে নজরুলের অমর সৃষ্টি যেভাবে বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করে—‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার হে/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝিপথ—/ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত/...ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যার জীবনের জয়গান—/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলীদান’। (নজরুল সংগীত সংগ্রহ, পৃ-২০৪)

গানটির প্রতিটি চরণে বাঙালির জাগরণের এক চিত্রকল্প ফুটে ওঠে। অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতন তথা স্বাধীকারের প্রশ্নে মানুষের মনে চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে নজরুল গানটিতে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। জাগরণী, দেশের গানসহ এরকম অসংখ্য গান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানুষকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এ সময় বেতার কেন্দ্রে গণসংগীত হিসেবে গাওয়া হতো—‘কারার ঐ লৌহ-কপাট/ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট রক্ত-জমাট/শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! ধ্বংস-নিশান/উঠুক প্রাচীর-প্রাচীর ভেদি’। (প্রাগুপ্ত, পৃষ্ঠা-২২১)

নজরুল কৃষক-মজুর-কুলী, ধীবরের গান, গণসংগীত, মার্চ সংগীত, সাঁওতালের গান, মাঝির গান, মল্লার গানসহ অসংখ্য গান রচনা করেছেন সব শ্রেণির মানুষের সংস্কৃতিকে প্রকাশ করার জন্য। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়টাকে মানুষকে প্রাণীত করার জন্য নজরুলের অসংখ্য গান, সে সময় পরোক্ষভাবে যুদ্ধে প্রভাব ফেলে—‘আজি রক্ত নিশি-ভোরে একি এ শুনি ওরে/মুক্তি-কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে/এ কাহারা কারাবাসে মুক্তি-হাসি হাসে/টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়া-তলে... জয় হে, বন্ধন মৃত্যু-ভয় হব, মুক্তি-কামী জয়!/স্বাধীনতা চিত জয়! জয় হে! জয় হে! জয় হে!’ (প্রাগুপ্ত, পৃষ্ঠা-৬৮৪)

বাঙালির মূল পরিচয়ের জায়গা চিহ্নিতকরণ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে দু’জনের ভূমিকা ছিল স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাদের জীবনের সবটুকুর বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছে তার হারানো গৌরব। বাঙালির ললাটে চির জয়ের চিহ্ন অঙ্কিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সরদার ফজলুল করিম বলেন—‘সংগ্রামী মুজিব অবচেতনভাবে হলেও অনুভব করেছিলেন স্বাধীনতার চাইতে ব্যাপকতর তাৎপর্যের শব্দ হচ্ছে মুক্তি। স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে যায় মুক্তি। তাৎপর্যের শব্দ হচ্ছে মুক্তি। স্বাধীনতার যদি ভৌগোলিক সীমা চৌহুদ্দি থাকে, মুক্তি অতিক্রম করে যায় সব সীমাকে; মুক্তি বঞ্চনা থেকে, মুক্তি বৈষম্য থেকে, মুক্তি শোষণ থেকে, মুক্তি সংকীর্ণতা থেকে, কুপমণ্ডুকতা থেকে, মুক্তি সব দীনতা থেকে। মানুষের জীবনে এর চাইতে মহৎ স্বপ্ন আর কী হতে পারে। সেই মহৎ স্বপ্ন উচ্চরিত হয়েছিল সেদিনকার সংগ্রামী মানুষের নিশান বরদার শেখ মুজিবের কণ্ঠে।’

জয় বাংলা। জয় নিপীড়িত বাঙালির কবি। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: সম্পা দাস, শিক্ষক, নজরুল সংগীত শিল্পী ও নজরুল গবেষক।