মেয়েটির ওড়না ও আমাদের মানসিকতা


মেহেদি রাসেল | Published: 2017-11-25 18:18:02 BdST | Updated: 2024-05-12 05:01:01 BdST

মেয়েটা হেঁটে হেঁটে ফিরছিলেন। তখন সন্ধ্যা সবে ঘনিয়েছে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরেই চলছিলেন তিনি। মোটরসাইকেলে দুই যুবক এসে প্রথমে আজে বাজে কথা বলে যান। একেবারে চলে যান না তারা, আবার মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে ফিরে এসে মেয়েটার ওড়না ছিনিয়ে নেন। কিছু দূর গিয়ে ওড়নাটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে তারপর বিদায়। ঘটনাটা সন্ধ্যা সাতটার। এলাকাটা মেয়েটির পরিচিত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের এ রাস্তা দিয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে একটি মেয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে গিয়ে এ হয়রানির শিকার হলেন। অনেকেই তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না কেউ, এড়িয়ে গেলেন। (২৩ নভেম্বর, প্রথম আলো)। প্রকাশ্যে এ ধরনের কুকর্ম কিন্তু বেড়েই চলছে। আর বাড়ছে এগুলো দেখে শুনে চুপ করে থাকার লোক।

এর আগে গত শুক্রবার (১৭ নভেম্বর ২০১৭) সকালে হলের সামনে থেকে এক ছাত্রীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান তাঁর সাবেক স্বামী। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনেকেই বলেছেন, বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা সম্প্রতি বেড়েছে এবং নারীরা প্রায়শই এ জাতীয় হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রশাসন তবু কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা যাদের আছে, তারা জানেন- শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হলো নিজেদের ঘরবাড়ির মতো। বিশেষ করে যারা হলে থাকেন, তাদের তো ক্যাম্পাসের প্রতিটি ইট-কাঠও চেনা। তো, ঘরের ভেতরেই যদি নারীরা এমন শ্লীলতাহানির শিকার হন তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এর জন্য প্রধানত দায়ী আমাদের মানসিকতা। আমাদের দেশের অনেক লোকের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, তারা বলবেন, সন্ধ্যার পর মেয়েদের বাইরে যাওয়ার দরকার কী?

আবার, গেলেও, একা যাওয়ার দরকার কী? এদের মূর্খতা ভুবনজয়ী, এদের মূঢ়তা তুলনাবিহীন। এদের মনোভাব আপনি সহজে বদলাতে পারবেন না। তবে, সহজে বদলানো যাবে না বলে কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারি না। কেননা, এরা সংখ্যায় অনেক। ফলে, এদের বাদ দিয়ে কোনো সমাজের সার্বিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
একটি মেয়ে যখন খুশি বাইরে যাবে। যেখানে খুশি যাবে। মেয়েরা বাইরে গেলে কিংবা একা গেলে, কিংবা গভীর রাতে গেলেও কোনো পুরুষ তাদের হয়রানি করার লাইসেন্স পেয়ে যায় না। সমাজের যে অগ্রসরতা, আমাদের অর্থনৈতিক যে উন্নতি, সেটা কি মেয়েদের ছাড়া এককভাবে শুধু ছেলেদের দ্বারা সম্ভব হতো?

চিন্তা করুন আমাদের পোশাক শিল্পের কথা, সেখানকার সিংহভাগ কর্মীই নারী। বিদেশে গিয়ে নামী ব্রান্ডের শার্টের কিংবা জিন্সের পেছনে ‘মেডইন বাংলাদেশ’ দেখে গর্বে আপনাদের বুক ফুলে যায়, কিন্তু সেটা যাদের রক্ত ও ঘামে তৈরি, তাঁদের আপনারা একা পেয়ে বাসে ধর্ষণ করেন, রাস্তায় একা দেখে ওড়না টেনে নেন, কটূক্তি করেন। এ কেমন গর্ব আপনাদের, এ কেমন দেশপ্রেম?

আমাদের দেশে কোনো মেয়ে হয়রানির শিকার হলে একটি বড় সংখ্যক মানুষ প্রথমেই আঙুল তোলেন ভুক্তভোগী মেয়েটার দিকে। মেয়েটা কেমন পোশাক পরে ছিল, মেয়েটা কেমন চলাফেরা করে, মেয়েটার চরিত্র কেমন, মেয়েটার বন্ধুবান্ধব কারা ইত্যাদি। এটি দীর্ঘদিনের অপচর্চার ফল। এটি একদল কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা চর্চার বাজে ফসল। এটি একদিনে তৈরি হয়নি। এই মনোভাব পুরুষকে রক্ষা করার জন্য তৈরি।

এ মনোভাব আপাতদৃষ্টিতে সরল এবং কার্যকারণ সন্ধানী মনে হলেও এর ফল ভয়াবহ। এটি অপরাধীর অপরাধের গুরুত্বকে খাটো করে ফেলে। একটি মেয়ে যা-ই হোন না কেন, তাঁর চরিত্র যেমনই হোক না কেন, তাঁর পোশাক যা খুশি হোক না কেন, তাঁকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। এমনকি একজন মেয়ে যৌনকর্মী হতে পারে, কিন্তু তাই বলে আপনি তাকে হয়রানি করতে পারেন না, জোর পূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না।

আইনত, সেটি ধর্ষণই হবে। ফলে, মেয়েদের পোশাক ও চরিত্র নিয়ে যারা কথা বলেন, প্রথমেই তাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। প্রথমেই তাদের বোঝানো উচিত সমস্যাটা নারীর নয়, সমস্যাটা অভিযুক্ত পুরুষের। নিজের প্রবৃত্তিকে দমনের ভার পুরুষকেই নিতে হবে।

নারীদের শুধু ভোগ্যবস্তু হিসেবে ভাবা এ সমস্যার অন্যতম কারণ। নারী যেন মানুষ নন, যেকোনো জড় বস্তুর মতো। ফলে, তাকে দেখভাল করার জন্য অভিভাবক আবশ্যক। আবার সেই অভিভাবককে হতে হবে পুরুষ। যেন সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে অক্ষম। তাই চলাফেরা করার সময় তার সঙ্গে একজন পুরুষ থাকতে হবে। সে একা বসবাস পারবে না।

ফলে, একাকী একজন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীও সহজে বাসা ভাড়া পান না। কোনো বাড়ির মালিক তাকে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। প্রতিটি পদক্ষেপে একজন নারী বাধার সম্মুখীন হন। তাঁর পায়ে যে পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়ি সেটা তাকে প্রতিনিয়ত আটকায়।

এই যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে যে ঘটনাটি হলো গত মঙ্গলবার, সন্ধ্যার সময়ে রাস্তাটিতে লোকজন থাকলেও কেউ যে এগিয়ে এলেন না, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এশিয়ার নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমলা ভাসিন-এর কথায়। তিনি বলছেন, ‘সমস্যাটা হলো, ১০ শতাংশ পুরুষ খারাপ আর বাকি ৯০ শতাংশ পুরুষ নীরব।’ (২৩ নভেম্বর ২০১৭, পরিবর্তন ডট কম)।

এই যে আমাদের নীরব পুরুষেরা, এরা কিন্তু অপরাধ সংঘটনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। কেননা, অপরাধীরা এখন জানে, প্রকাশ্যে অপরাধের জন্যও তাদের বাধা পেতে হবে না। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমাগত বাড়ছে।
চোখের সামনে অনায়াসে অপরাধ করে যাচ্ছে তারা। আবারও, কমলা ভাসিনের কথা ধার করে বলা যায়, যেহেতু ৯০ ভাগ পুরুষ নীরব থাকে, ফলে অপরাধী ও নিষ্ক্রিয় পুরুষ একাকার হয়ে যায়। ভালো থেকে মন্দটা আলাদা করা যায় না, নারীর চোখে সব পুরুষই হয়ে ওঠে সন্দেহভাজন। কমলা ভাসিন আরও একটি দারুণ কথা বলেছেন, ‘ধর্ষণটা পুরুষের ইস্যু, নারীর নয়। তুমি পুরুষ আমাদের রেপ করছ, আমাকে কোনো নারী রেপ করছে না। তো, পুরুষের ইস্যুটাকে কেন শুধু নারীরাই শুধু রিমুভ করার দায়িত্ব নেবে।

কেন তুমি পুরুষকে থামাচ্ছো না অথচ নারীকে বের হতে নিষেধ করছো?’ সত্যিই তো, নিপীড়ন বা ধর্ষণের সমস্যাটা পুরুষের, অথচ নারীর সামাজিক সম্মান তাতে ভূলুণ্ঠিত হয়! পুরুষটি অপকর্ম করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর নারী চার দেয়ালের মাঝে মুখ লুকিয়ে পালাবার পথ পায় না, অনেকে আত্মহত্যা করেন। সমাজে যদি এ ইস্যুগুলো দেখার ধরন বদলাতো, তাহলে নারীদের এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে হতো না, বরং পুরুষেরাই লজ্জায় মুখ লুকাতো।

ব্যাপারটা শুরু হতে পারে পরিবার থেকে। এখনও আমরা আমাদের মেয়েদের বলি শালীন কাপড় পরতে, ভদ্রভাবে চলাফেরা করতে, একাকী দূরে কোথাও না যেতে, সন্ধ্যার পর বাইরে না থাকতে। কিন্তু আমাদের ছেলেদের কি বলি মেয়েদের যথাযথ সম্মান দিতে, তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করতে? তাদের কি বলি, ছেলে আর মেয়েতে কোনো বৈষম্য নেই?

মানুষে মানুষে যে পার্থক্য সেটি লিঙ্গ কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্য দিয়ে নয় বরং তার মানবিক গুণাবলি দিয়ে বিচার করতে? আমাদের পরিবারের ছেলেদের সুশিক্ষা ও নৈতিকতা শেখানোর সময় এখনই।

মেহেদি রাসেল : সাংবাদিক, গল্পকার ও কলামিস্ট।
[email protected]

আইএইচ/ ২৫ নভেম্বর ২০১৭