ডাকসু নির্বাচন হয় না কেন?


শফিকুল ইসলাম খোকন | Published: 2017-11-28 03:34:20 BdST | Updated: 2024-05-12 05:57:36 BdST

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিত। এ গণতন্ত্রের পেছনে ডাকসুর অনেক অবদান রয়েছে। এ অবদানের কথা চিন্তা করে আশা করছি, নতুন উপাচার্য পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ না করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন। শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা যেহেতু সবাই চান ডাকসু নির্বাচন হোক, সে কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ড. আখতারুজ্জামান একজন মডেল হতে পারেন। তাহলে ঢাবি একটি নতুন রূপে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করতে পারবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য দায়িত্ব পাওয়া উপাচার্য ড. অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘Fair seat time’ অর্থাৎ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়েই বীজ বপন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবনে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যেমনটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’ এ কথাটির সঙ্গে আমি কেন, দেশের শতভাগ মানুষই একমত হবেন। সত্যিকার অর্থেই উপযুক্ত সময়ই সঠিক কাজ করতে হয়। তা না হলে সারা জীবনই কাঁদতে হয়। এ কথাটি শুধু মানুষের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়- ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্যও। যেমনটি উপযুক্ত সময়ে সঠিক নির্বাচন না হওয়ায় আজ ‘ডাকসু’ কাঁদছে। এ কাঁদাটা শুধু এক নয়, দুই নয়, ২৭ বছর ধরে চলছে। কিন্তু এ কান্না কেউ থামাচ্ছে না বা থামাতে পারছেও না। অনেকের কান্না দেখে শান্তি পায় কেউ কেউ। আবার অনেকেই চাইছেন ডাকসু নির্বাচন হোক, কিন্তু কাজের কাজ কেউ করছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) গঠিত হয় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল অবদান রাখে এ সংগঠনটি। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময় স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ডাকসু।

ডাকসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। এ প্রজন্মের অনেকেই এ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হয়তো তারা কিছুটা পরিচিত। কিন্তু অনেকেই জানে না ডাকসু কী, কী তার দায়িত্ব। এ প্রজন্মের কাছে ডাকসু হয়ে গেছে ইতিহাস। এ সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, যারা দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় দেখভালের- তা সে শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই হোক আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পদ্ধতির স্বচ্ছতাই হোক। নিয়মমতো এ সংসদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও শেষ অবধি তা দেশ-জাতির প্রয়োজনে ছাড়িয়েছে তার সীমা। ডাকসুর অবদানের কথা ভোলার নয়। ডাকসু দিয়েছিল ’৫২, দিয়েছে ’৬৯, দিয়েছে ’৭১। শুধু কি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, না তা নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া অপশাসন-স্বৈরশাসককে রুখে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে- ডাকসু এতকিছু করার পরও দীর্ঘ ২৭ বছরেও কেন নির্বাচন হয়নি? নির্বাচন না করার কারণগুলোইবা কী? এক্ষেত্রে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও শিক্ষক সমাজকে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় কাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থানকে পরিকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এ ‘কেন’ ও ‘কারণ’ খুঁজে বের করার কাজটি অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে হয়।

গণতন্ত্রের নামে মুখে মুখে খই ফুটিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো ঢালাওভাবেই বলে যাচ্ছেন ডাকসু নির্বাচন চাই। কিন্তু মুখেই শুধু বলে যাচ্ছেন, বাস্তবে কেউ এগিয়ে আসছেন না। এর আগে দেখেছি, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোসহ সবাই চায়, তারপরও ২৭ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন দিতে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মোঃ আবদুল হামিদের তাগিদকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এরপরও ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ না নেয়ায় অজানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ২৭ বছরেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াকে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক’ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

লক্ষণীয়, ১৯৯০ থেকে বিভিন্ন সময় ডাকসু নির্বাচনের ‘মুলা ঝুলিয়েছেন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু তা শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ২০১৭ সালে এসেও তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। জানা গেছে, ১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ নির্বাচনের ১ বছর পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তখন ছাত্রনেতারা ছাত্রত্ব ঠিক রেখে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় নির্বাচন ভেস্তে যায়। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে সে সময়ের ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেন। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার দোহাই দিয়ে ছাত্রলীগের বাধার মুখে নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালেও ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেবারও একইভাবে নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ব্যর্থ হন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হন। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৩ মে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে তখনকার মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙে দেয়া এবং পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী ওই বছর ২৭ মে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী দুইবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন; কিন্তু তা-ও আলোর মুখ দেখেনি।

তৎকালীন উপাচার্যের দাবি, সে সময়ের বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগিতার কারণেই ডাকসু নির্বাচন দেয়া সম্ভব হয়নি। সবশেষ চলতি বছর ১৯ মার্চ বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। শিক্ষা সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে; কিন্তু তাতেও কোনো কাজের কাজ হয়নি।

রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আচার্য মোঃ আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে (৫০তম) বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট (হতেই হবে)। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ডাকসুর পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্টসহ ক্যাম্পাসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠনই ডাকসুর দাবি জানাচ্ছে। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ১২ আগস্ট, ২০১৭)। এত দাবি, এত চাওয়া, তারপরও কেন নয় পাওয়া? কেন হচ্ছে না ডাকসু নির্বাচন? বাধা কোথায়? এতকিছুর পরও আশা ছাড়া যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের গেল ২৪ আগস্ট মেয়াদ শেষ হওয়ায় ড. অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে ৪ সেপ্টে¤¦র নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদ। তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ৬ সেপ্টে¤¦র। নিয়োগ পাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। এখানে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকেই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাই।’ (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, ৬ সেপ্টে¤¦র, ২০১৭)। তিনি আরও বলেন, ‘ঋধরৎ ংবধঃ ঃরসব বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়েই বীজ বপন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবনে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যেমনটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’ (সূত্র : বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কম)। ভিসি আখতারুজ্জামানের কথার ওপর একমত হয়ে অনেক দেরি হলেও আশা ছাড়ছি না। আমরা আশা করছি, তিনি ডাকসু নির্বাচন দেয়ার বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অনেক দিন সহ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের কোথায় কী দুর্বলতা ও অব্যবস্থা আছে, তা তার অজানা নয়। তিনি সেসব নিরসনে সচেষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করা যায়। তার প্রথম দায়িত্ব হবে আগের উপাচার্যের সময় শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, সেগুলো নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করা। দ্বিতীয়ত, ডাকসু নির্বাচন দেয়া। তার সহযোগীদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান উৎপাদনেরও জায়গা।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিত। এ গণতন্ত্রের পেছনে ডাকসুর অনেক অবদান রয়েছে। এ অবদানের কথা চিন্তা করে আশা করছি, নতুন উপাচার্য পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ না করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন। শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা যেহেতু সবাই চান ডাকসু নির্বাচন হোক, সে কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ড. আখতারুজ্জামান একজন মডেল হতে পারেন। তাহলে ঢাবি একটি নতুন রূপে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করতে পারবে।

শফিকুল ইসলাম খোকন
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয়
সরকার গবেষক
[email protected]

এমএস/ ২৭ নভেম্বর ২০১৭