ছাত্র রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ


টাইমস অনলাইনঃ | Published: 2019-09-04 18:04:07 BdST | Updated: 2024-05-18 06:24:09 BdST

ছাত্র রাজনীতি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ শতকের প্রথম পাদে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে। তবে এর আগে যে ছাত্র রাজনীতি একেবারেই ছিল না তা বলা যাবে না। পাশ্চাত্য শিক্ষার একটি বৌদ্ধিক প্রতিক্রিয়া হলেও তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গল ছিল ছাত্রদেরই একটি আন্দোলন। এটি ছিল মূলত প্রচলিত নিয়মাচারের প্রতি এক ধরনের বিদ্রোহ। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী সামাজিক ও অন্যান্য ব্যাপারেও আগ্রহী ছিল, যেগুলি পরবর্তীকালে রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে আনন্দমোহন বসু ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদানের আহবান জানান এবং ছাত্রদের রাজনীতি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, বিশেষত স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কড়া শাসন ছিল ছাত্রদের রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা। এ ছাড়া উনিশ শতকের শেষভাগের পূর্ব পর্যন্ত উপনিবেশিক সরকারের একটি চাকুরির জন্য কিছুটা বিদ্যার্জন ছিল সকল শ্রেণীর ছাত্রের সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষ।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রণোদনা জোগায়। জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি গঠিত হওয়ার আগে বাঙালি ছাত্রদের কোনো নিজস্ব সংগঠন ছিল না। এ সংস্থার সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে প্রমোদ কুমার ঘোষাল এবং যাদবপুর (জাতীয়) ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ও ছাত্র পত্রিকার সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, আর অতিথি বক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সংস্থার গঠনতন্ত্রের কাঠামো ছিল কংগ্রেসের আদলে তৈরি। একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও ১৯ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি নিয়ে সমিতির কাঠামো গঠিত হয়। গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত না থাকলেও কার্যত নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি ছিল কংগ্রেসের ছাত্রফ্রন্ট।

বিশ শতকের বিশের দশকের রাজনীতিতে মুসলিম ছাত্রদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিলই না। মুসলিম অভিভাবক ও নেতারা তাদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের উদ্যোগে গঠিত নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকা শহরের কয়েকজন মুসলিম বুদ্ধিজীবী নিজেদের একটি ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ফলত ১৯৩০ সালের ১২ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রদের একটি সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ্কে একটি মুসলিম ছাত্র সমিতি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৯৩২ সালে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা ছিল এ ছাত্রসংগঠনের ঘোষিত নীতি। ইতঃপূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লে. কর্নেল এইচ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার আহবান জানিয়েছিলেন।

কিন্তু মুসলিম ছাত্রদের এ সংগঠনটি আসলে মুসলিম রাজনৈতিক নেতারাই পরিচালনা করতেন এবং তাদের নানা দল-উপদল এটি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। এভাবেই অভিন্ন সংগঠনভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও টেইলর হোস্টেল ও কারমাইকেল হোস্টেলের ছাত্ররা যথাক্রমে মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টি এ দুটি রাজনৈতিক দলের অনুগামী হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচনকালে এ ধারা আরও ঘনীভূত হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৭ সালে গঠন করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন এবং ওই বছরই কলকাতায় এর বঙ্গীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে খুব কমসংখ্যক মুসলিম ছাত্রই এসব রাজনৈতিক সংগঠনে আগ্রহী ছিল।

কিন্তু ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর এবং জিন্নাহর নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম লীগের বিস্তার ঘটলে ছাত্ররা মুসলিম লীগ নেতাদের অনুগামী হয়ে ওঠে। কলকাতায় ইস্পাহানি ও ঢাকায় খাজাদের ভবনগুলি ছাত্রদের ওপর মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৩৮ সালে বাংলায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন নামকরণ হয় অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। পুনর্গঠিত এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ঢাকার আবদুল ওয়াসেক ও যশোরের শামসুর রহমান। এ মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পূর্ববাংলার মুসলিম ছাত্রদের ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। ঢাকার নবাব ছিলেন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক। মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক যোগদান নিশ্চিত করেছিল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর মুসলিম ছাত্রলীগের ওপর খাজা পরিবারের প্রভাব লোপ পায়। মুসলিম লীগের খাজাবিরোধী উপদলটি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ থেকে বেরিয়ে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করে। এ বছরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং তাতে নেতৃত্ব দেয় এ ছাত্রলীগ। এ জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান সুজ্ঞাত ও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু ভাষাসমস্যার সমাধান হলেও ছাত্র আন্দোলন থামে নি। বিভাগোত্তর রাজনীতিতে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিকদের যতগুলি উপদল গড়ে উঠেছিল ছাত্রসংগঠনও ছিল ঠিক ততগুলিই। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ও উপদল নিজস্ব ছাত্রফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাইত। ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত স্টুডেন্টস ফোর্স ও ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের আগে ও পরে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী উপদলগুলোকে সর্মথন করত।

১৯৬৮-১৯৭১ সময়কাল ছিল ছাত্র রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকের রাজনৈতিক পটভূমিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়লে ছাত্রসংগঠনগুলোতেও অনুরূপ বিভক্তি দেখা দেয়। ছাত্রদের এ বিভক্তির দরুন জনসমক্ষে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে থাকে।

তারপরই ঘটল ১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে। এ লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে। পরিষদ গোড়ার দিকে ১১-দফা দাবির জন্য আন্দোলন করলেও পরবর্তীকালে ছাত্রনেতারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন। পরিষদের নেতারা জাতীয়তাবাদী অর্থে ‘বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার করেন। তারা ‘জয় বাংলা’ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জাতীয় স্লোগান ও প্রতীক উদ্ভাবন করেন।

১৯৬৯ সালের গোড়ার দিকের যে গণ-অভ্যুত্থান আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য করে, তা ছিল প্রধানত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দ্বারাই সংগঠিত। ফলত এ পরিষদ দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের এ প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন।

ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এ প্রথম ছাত্রসমাজ একটি স্বাধীন অবস্থান অর্জন করে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মকান্ডের স্বাক্ষর রাখে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পরদিন তারা পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করে। একই সভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। তারপরই শুরু হয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জনগণকে সংগঠিত করার এক উদ্যোগ। শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।

ছয়দফা রাজনীতির আওতায় ২ মার্চ থেকে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ অসহযোগ আন্দোলন সংগঠনে আত্মনিয়োগ করে। ছাত্রদের এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন এতই ব্যাপক ও বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি এতটাই সম্মোহক হয়ে উঠেছিল যে তাতে ছয়দফা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে এক প্রতীকী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্ত্তত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি। উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার যথার্থভাবেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয়তাবাদী অভিধাগুলি, যেমন দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রসংগঠনগুলোর বীরত্বপূর্ণ অবদান সর্বজনস্বীকৃত ও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী গোড়ার দিকের বছরগুলোতেও ছাত্রদের ভূমিকার মধ্যে স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রসমাজের অভ্যুদয় সুচিহ্নিত হয়ে আছে। তবে এ সময়কার সরকারের অনুসৃত সবগুলি নীতি ও উদ্যোগের সঙ্গে ছাত্ররা একমত হতে পারে নি। সরকারের সঙ্গে এ বিরোধ থেকেই ছাত্রদের একটি অংশের উদ্যোগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রদল নামের একটি নতুন ছাত্রসংগঠনের জন্ম হয়।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দিলেও তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির ভাবমূর্তি অব্যাহত রাখা সম্ভব হয় নি। নানা কারণে এর দ্রুত অবক্ষয় ঘটছিল। এর প্রধান কারণ ছিল ছাত্ররাজনীতিতে স্বকীয়তার অভাব। ছাত্রসংগঠনগুলো ক্রমেই পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের উপাঙ্গ হয়ে উঠছিল। ছাত্রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টায় সবগুলো প্রধান রাজনৈতিক দল ও উপদল ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে অ-ছাত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে। নানা ছাত্রসংগঠনের অ-ছাত্র নেতারা নিজ দল ও অন্যান্য দলের মধ্যেকার কোন্দলে ছাত্রদের ব্যবহার করতে শুরু করে এবং ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মিদের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে নস্যাৎ করার জন্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের ফলে জনগণের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির ভাবমূর্তি দ্রুত বিনষ্ট হতে থাকে। এসব কারণে বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে নানা মহল থেকে। [মোহাম্মদ হান্নান]

ছাত্র রাজনীতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একটি প্রবন্ধে ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে লিখেছিলেন- ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানে নিজেকে গড়ে তোলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির সূচনা, বিস্তৃতি এবং অবদান প্রধানমন্ত্রীর কথাকে যথার্থ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে বিশেষ করে অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতা দুর্বল, সেখানে ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। যেহেতু ছাত্ররা সমাজের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ সচেতন অংশ, সেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছাত্র সমাজের বিশেষ ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। ‘জার’ আমলে রাশিয়ায় ছাত্ররাই বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। এমনকি ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনায়, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায় ছাত্র সমাজ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬৪ সালে দ. ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ার ক্ষেত্রেও জাতীয় সংকটে ছাত্র সমাজের অবদান ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি ত্রিয়মান কোনো ঘটনা নয়। এদেশও ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম। পরবর্তীতে ’৯১-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা। আর এ কারণেই জনগণের কাছে ছাত্র রাজনীতির আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা আমাদের দেশে ছিল এবং এখনও কিছুটা রয়েছে।

যে সফলতার ইতিহাস এতক্ষণ বললাম সেখানে কারা নেতৃত্বের আসনে ছিল, তাদের বৈশিষ্ট্য কী ছিল, পরবর্তী জীবনে দেশের জন্য তাদের অবদান কী ছিল সেগুলো ব্যাখ্যা না করলে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির পোস্টমর্টেম সম্ভব হবে না। ওই সময় ছাত্র রাজনীতিতে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের দূষণ পরিলক্ষিত হয়নি। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই নেতৃত্বে আসতেন এবং তারা সমাজে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান পেতেন। ব্যক্তিস্বার্থ বা আর্থিক সুবিধার জন্য কেউ ছাত্র রাজনীতি করতেন না। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির বহুল পরিচিত চার খলিফা (নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন) থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন এবং ওই সময়ের অন্যসব জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারাও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি তারা প্রায় সবাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।

ওই সময়ের ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল প্রগতিশীল দর্শন হিসেবে, জীবনবোধ ও সৃজনশীলতা তৈরির অনুঘটক হিসেবে কাজ করার জন্য। সেই আমলে ছাত্রদের রাজনীতি ও আন্দোলন করার মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং অধিকার সচেতনতা ছিল। দেশ ও দেশের মানুষের স্বাধিকার ও অধিকার আদায়ের তীব্র বাসনা কাজ করত ছাত্রদের মধ্যে। বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে তাদের মধ্যে তীব্র আবেগ কাজ করত। যেই আবেগ দিয়ে তারা তথাকথিত পশ্চিমা শিক্ষিতদের কূটকৌশল, সশস্ত্র পাকিস্তানিদের শোষণ আর স্বৈরাচার সামরিক শাসকের বেয়নেটের হুংকারকে পরাজিত করতে পেরেছিল।

গত তিন দশকে ছাত্র রাজনীতির চারিত্রিক ও গুণগত মান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ’৭৫-র পটপরিবর্তন, সামরিক শাসনগুলো ছাত্র রাজনীতিকে বৈষয়িক স্বার্থকেন্দ্রিক করে তোলে। ওই সময়ে ছাত্র রাজনীতি তার চিরায়ত গণমুখী ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতামুখী দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে শেখে। তাই ছাত্র রাজনীতি আর আধিপত্যের সম্পর্ক একটি আরেকটির অভিযোজন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া ছাত্র রাজনীতির সর্বোচ্চ হাতিয়ার ছিল লেখাপড়া, বইখাতা, কাগজ-কলম, লাঠি-বিড়ি। আর এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হল- মদ-গাঁজা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শন, মাদক বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, হলে সিট বাণিজ্য, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কাটা রাইফেল, রিভলবার। এগুলোর পরে যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছুটা লেখাপড়া আর নামকাওয়াস্তে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শুধু ছাত্রত্ব ধরে রাখার জন্য। তাও নাকি বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতারা নিয়মিত করেন না। যথাসময়ে পাস করে বের হয়ে গেলে নাকি পদ-পদবিপ্রাপ্ত নেতা হওয়া যায় না। যারা বর্তমান ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বে রয়েছে, তাদের প্রথমেই হতে হবে অপেক্ষাকৃত মেধাশূন্য অথবা ভান করতে হবে কিছুই জানে না এমন, হতে হবে ভালো চামচা, থাকতে হবে পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির সামর্থ্য। এগুলো থাকলেই উপরের আশীর্বাদ পাওয়া যাবে এবং ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা মিলবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতি আমাদের দেশ ও জনগণের সামনে দেখা দিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। জনগণ এখন আর ছাত্র নেতাদের আগের মতো সম্মান করে না। ছাত্র রাজনীতিকেও জনগণ সহজভাবে ও ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না। জনগণ ছাত্র রাজনীতির প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। এর কারণ কী? তরুণ ও মেধাবী ছাত্ররা আজকে কেন রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে? কিছু শিক্ষাঙ্গনে আজকে কেন লিখে দেয়া হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি মুক্ত’? বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে, ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে একজন ছাত্র নিজের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ, নিজেকে সন্ত্রাসী বা চোরাকারবারির বা অন্যের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে গড়ে তোলে।

বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের সাধারণ মানুষ আদর্শহীন, চরিত্রহীন, অর্থলোভী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ, মূর্খ সর্বোপরি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মানুষ বলে মনে করেন। কিন্তু এ কথাও সত্য এবং ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত, ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রাথমিক ভিত তৈরি হয়েছে এবং আদর্শবান ছাত্র নেতারাই রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সেই ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর ঐতিহ্য আজ অনুপস্থিত। ইচ্ছা করলেই ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধের মতো আবেগী অনুষঙ্গ আজকে তৈরি করা যাবে না। বর্তমান সময়ের অনুষঙ্গ নতুন, ক্ষেত্রবিশেষ অতীতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মত প্রকাশের বাঁধা, বেকারত্ব, হত্যা, খুন, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো ইস্যুগুলো এ দেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা তৈরির পথে প্রধান বাধা হিসেবে জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের সমাজের ওপর চেপে বসছে। এর থেকে মুক্তির জন্য আজকের ছাত্র সমাজ কেন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখনও তো সারা দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ বন্ধ থাকার কারণেই ছাত্র রাজনীতি বর্তমান সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো ভালো কাজ সফলতার মুখ দেখে না। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরকার ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছাত্র সংগঠন এমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করে রাখে যেখানে প্রতিযোগিতার কোনো পরিবেশ থাকে না। যেখানে ভিন্নমত, ভিন্নদল থাকবে না, সেখানে মেধাবী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে না। ছাত্র রাজনীতিকে আবার দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নেতৃত্বের সূতিকাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে সব রাজনৈতিক মত ও দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিদ্বন্দ্বি^তা নয়, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিই পারে ছাত্র রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে আবার গ্রহণযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে। রাতের আঁধার যতই গভীর হোক না কেন, সকালের সূর্য অবশ্যই উদিত হবে। আমার বিশ্বাস নির্লোভ, আপসহীন ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে অচিরেই ছাত্র রাজনীতি সুষ্ঠু ও সঠিক ধারায় ফিরে আসবে আর তখনই ছাত্র রাজনীতির প্রতি জনগণ আস্থাশীল হবে।
মেজর রেজা উল করিম (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সূত্রঃ বাংলা পিডিয়া ও যুগান্তর