বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি ও কিছু কথা


মাহমুদ অাব্দুল্লাহ বিন মুন্সি, | Published: 2017-10-26 05:51:13 BdST | Updated: 2024-05-14 15:09:10 BdST

তুন শিক্ষাবর্ষে নবীন শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ভর্তিযুদ্ধ জয় করে আসা মেধাবী মুখগুলো উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হচ্ছে স্বপ্নে লালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ পছন্দের প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাবে কেউবা অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হবে।

এই স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের সংমিশ্রণে শুরু হবে একটি নতুন জীবন, নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন দেখা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগপ্রাপ্তদের একটি অংশের যাত্রা শুরু হবে নতুন একটি অধ্যায়ের। অধ্যায়টির নাম হল অধ্যায়।

আবাসিক হলগুলোর কক্ষ, বিছানা, মেঝে, বারান্দা, করিডোর এবং ছাদ এবং ছাড়পোকার বুকে আশ্রয় হবে স্কুল, কলেজ দাপিয়ে চমক দেখানো ফলাফল করে আসা বোর্ড সেরা শিক্ষার্থীদের। গণরুমের ঘিঞ্জি পরিবেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে দেশের সর্বত্র থেকে উঠে আসা নবীনরা।

আবাসিক হলে উঠে একজন শিক্ষার্থী শুরুতেই পরিচিত হবে র‍্যাগিং কিংবা গেস্ট রুমের মত অধ্যায়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে র‍্যাগিং এর দরকার আছে কিনা, ম্যনার শিখানোর জন্য গেস্ট রুম করানোর প্রয়োজন পড়ে কিনা! এই ব্যাপারগুলো নিয়ে বিতর্ক আসতে পারে।

তবে ঢাবিতে পড়া এবং আবাসিক হলে থাকার সুবাদে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়, নতুন পরিবেশে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশাল একটি জায়গার সাথে খাপ খাওয়ানো কিংবা বিশ্ববিদ্যালিয়ের পরিমন্ডলে কমিউনিটি বিল্ড আপ এর জন্য গেস্ট রুমের দরকার অবশ্যই আছে।

মূল আলোচনায় ফেরা যাক, এই যে নবীন ছেলেমেয়েগুলো একদমই অপরিচিত একটি জায়গায় এত সংখ্যক অপরিচিত মানুষের সাথে মিশবে। কলেজ পর্যন্ত পার করে আসা জীবনকে বিদায় জানাবে। এই শিক্ষার্থীরা (বিশেষ করে গ্রাম থেকে আসা) এমনিতেই ভয়ের মধ্যে থাকে! তাই শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় বা হল কালচারের সাথে মানিয়ে উঠতে পারেনা। যার ফলশ্রুতিতে ভুলও করে অনেক বেশি।

হল গেস্ট রুমের নেতৃত্বে থাকে মূলত ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচ যারা কিনা মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বর্ষ শেষ করতে যাচ্ছে। সাধারণত গেস্ট রুমে কমন ম্যানার শেখানো হয়। এবং নবীনদের ভুলের কারণে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়।

কিন্তু! সমস্যাটি হচ্ছে প্রতি হলের গেস্ট রুমেই কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকে যারা অতিউৎসাহী হয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয়। একটি ছেলে চলতে ফিরতে গেলে একজন কে না দেখা কিংবা কোন সিনিয়র তার দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু কোন কোন সিনিয়র সেই ব্যাপারটিকে তিলকে তাল বানিয়ে গেস্ট রুমে ঐ পার্টিকুলার জুনিয়রকে হেনস্তা করে থাকে। অনেকে ভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যও এই কাজ করে। তারা একটা জিনিস বুঝতে চায়না যে, হেনস্তা হওয়া ছেলেটির তখনকার মানসিক অবস্থাটা কেমন থাকে।

আপনাকে কোন জুনিয়র সালাম না দিলে, হ্যান্ড শেইক না করলে বা এড়িয়ে গেলে ব্যাপারটা এমন নয় যে, জুনিয়রটি বেয়াদব। হয়তোবা ছেলেটি তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল তাই আপনি তার দৃষ্টিতে পড়েননি কিংবা আপনি তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন তাই ছেলেটি আমাকে সম্বোধন জানাতে পারেনি। আবার আরেকটি ব্যাপারও হতে পারে যে আপনি নিজেই সম্মান পাওয়ার মত ব্যক্তিত্ব নন।

তাছাড়া, সম্মান ব্যাপারটা জোর করে আদায় করার কোন বস্তু নয়। ভয় দেখিয়ে, ফোর্স করে, গালি দিয়ে (অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে এই প্রবণতা আছে) আর যাই হোক সম্মান পাওয়া যায়না। আপনি সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হলে জুনিয়ররা আপনাকে এমনিতেই সম্মানিত করবে। বলা লাগবেনা।

আমি দেখেছি অনেক শিক্ষার্থীকে যাদের মধ্যে গেস্ট রুমকে ব্যাবহার করে অনেক সময় অযৌক্তিক কারনে জুনিয়রদের হেনস্তা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই উগ্র ছেলেগুলো অরাজনৈতিক কিংবা আধা রাজনৈতিক হয়। কেননা রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন ছাত্র কখনোই সম্মান আদায়ের জন্য অহেতুক কাউকে হেনস্তা করেনা। তাই এদের মধ্যে রাজনীতিতে সফল হওয়া ছাত্রনেতা খুজে পাওয়াই যায়না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি দেখেছি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ছাত্রটির অনেক আগেই ভুক্তভোগী ছাত্রটি সফল হয়েছে। গেস্ট রুমে হুংকার করা ছেলেটিকে দেখেছি ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বছরের পর বছর হলে চাপা কান্না নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্যদিকে গেস্ট রুম থেকে হেনস্তার শিকার হয়ে কান্না করা ছেলেটিকে দেখেছি অনায়াসেই মেধার স্বাক্ষর রেখে স্বাস্থ্যবান সেলারি নিয়ে হল ছাড়তে।

একটা কথা মনে রাখা উচিত। আজকে যেই ছেলেটি মোস্ট জুনিয়র ব্যাচ, পরের বছরই সেই ছেলেটি ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের আসনে বসে। এবং বছর শেষে ঐ নবীন নিরীহ জুনিয়রটিও ক্যাম্পাসের সুচতুর কিংবা পরিপক্ব ছেলে হয়ে ধাপড়ে বেড়ায়। এবং চোখ খুলে যাওয়া এই জুনিয়রগুলো তখন আর বাধ্য থাকেনা আপনাকে সম্মান করার। তারাও তখন বাছাই করেই সম্মান প্রদর্শন করে।

সুতরাং, নতুন আসা এই মুখগুলোকে ভালবাসতে শিখুন ওরাও আপনাকে ভালবাসবে। আর সালাম, হ্যান্ড শেইক? এইগুলো তখন সয়ংক্রিয়ভাবেই (লেখক ) আসবে। যে জুনিয়রটি আপনাকে ভালবাসবে সেই জুনিয়রটি অবশ্যই সম্মানও করবে। আর এই সম্পর্কটি কিন্তু এক বছর বা ক্যাম্পাসের ৫  বছরের সম্পর্ক থাকেনা। এটি সারাজীবনের সম্পর্ক হয়ে যায়। ক্যাম্পাস পরবর্তী জীবনেও ঐ জুনিয়র-সিনিয়র সম্পর্কটি থেকে যায়। ভাল ও খারাপ দুটি আচরণই একটি ছেলের মনে সারাজীবন গেঁথে থাকে।

সবশেষে বলতে চাই, আজকের ভালবাসা থেকে পাওয়া সম্মান এক বছর, পাঁচ বছর কিংবা এক যুগ পরেও সম্মানই থাকে। কিন্তু, জোর অথবা ভয় থেকে পাওয়া সম্মানটি বছর ঘুরেই ঘৃণায় পরিণত হয়।

লেখক:
মাহমুদ অাব্দুল্লাহ বিন মুন্সি,
সভাপতি,
ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি