“৯০-এর দশকের কোন এক দুপুর। তখন এসএম হলের দিকে বুয়েটের একটা গেইটা ছিল। হঠাৎ করে হে রে রে রে করে একদল ‘মেধাবী ছাত্র’ সেই গেইট দিয়ে ঢুকে পড়লো। তাদের কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে হকি স্টিক আর কারও হাতে বালতি। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেধাবী ছাত্রদের হাতে মার খেয়ে গেল বোকা-সোকা একগাদা বুয়েটিয়ান। পিটুনি দিয়ে মন ভরলো না ঢাবিয়ানদের। তাদের বালতিগুলোতে ছিল পেট্রোল। নিমেষে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো সিভিল আর ইএমই বিল্ডিং-এর পার্কিং-এ রাখা কয়েকটা গাড়ি! ইএমই বিল্ডিং-এর দোতলায় দাড়িয়ে আ মু জহুরুল হক স্যার দেখলেন তার গাড়িটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। মেধাবী ঢাবিয়ানরা বিজয়ীর বেশে বীরদর্পে চলে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বুয়েট যে কাজটা করলো সেটা হলো
এসএম হলের দিকের দরজাটা দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দিল। কিন্তু গঞ্জিকাসেবী মেধাবীদের কি দেয়াল দিয়ে রোখা যায়? ওরা রাস্তার উল্টোদিকে বাস চালায়, মেডিকেলে গিয়ে ভাঙ্গচুর করে আর হকিস্টিক দিয়ে বুয়েটের ছেলেদের মাথা ফাটিয়ে রেখে যায়। কারণ ওরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র! ছি!”

তবে সেই ভুল ভাঙ্গলো মুনির ভাইয়ের স্ট্যাটাস প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মধ্যে চ্যানেল আই অনলাইনের আব্দুল্লাহ আল সাফির ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। তিনি লিখেছেন যে, “যারা অনেক অনেক অনেক পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে ভর্তি হয়, তারা অবশ্যই অনেক মেধাবী। তবে ‘সিস্টেম’ করে যারা ভর্তি হয় এবং যারা ওইসব ‘সিস্টেম’ তৈরি করে পালসার, অ্যাপাচে বা ইয়ামাহা চালিয়ে বেড়ায়… তারাই হয়তো মাঝে মাঝে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমানা লঙ্ঘন করে ফেলে… তবে একজন এক্স-বুয়েট ছাত্রের অভিযোগ, বুয়েটে ‘সাংবাদিকতা বিভাগ’ না থাকায় দেশের গণমাধ্যমে তাদের ভয়েস ও ঘটনার আসল চিত্র সেভাবে উঠে আসছে না…”।

এই দুই স্ট্যাটাসের পটভূমি খুঁজতে গিয়ে মানবজমিন নামের সংবাদপত্রে শিরোণাম পেলাম- গাঁজা সেবন নিয়ে ঢাবি ও বুয়েট ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ। সংক্ষেপে খবরের বিস্তারিত হলো- গাঁজা সেবনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্রলীগের মধ্যকার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসময় বুয়েট ছাত্রলীগের পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয় বলে জানা গেছে। যার মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।

গাঁজা নিয়ে মারামারির এই ঘটনা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো স্মৃতির পাতায়। আশির দশকের শেষভাগে আমার এক গৃহ শিক্ষক ছিলেন। বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। থাকতেন তিতুমীর হলে। আমি কয়েকবার তার হলে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন কীভাবে হলে টবে ফুল গাছের পাশাপাশি গাজার চাষ করতেন তৎকালীন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। আমার অবাক হওয়া দেখে তিনি বলেছিলেন, এটা নিয়ে যেন কথা না বলি। কারণ তিনি নিজেও এটা পছন্দ করেন না। কিন্তু যে ছাত্ররা চাষ করে তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী। তার মধ্যে একজন তার রুমমেট। এটা ৮০ এর দশকের শেষভাগের কথা। ততোদিনে আইন করে দেশে গাজা চাষ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ফুলের টবে গাজা চাষ করতেন যা আমি নিজে দেখেছি।

আশির দশকে আমার দেখা সেই ফুলের টবে গাজার চাষ যে থেমে থাকেনি সেটা বোঝা যায় ২০১৬ সালের এক নিউজ থেকে। গত বছর আগস্ট মাসে পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায় যে, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুইজনসহ মোট ৪ জন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে হলে ফুলের টবে গাজা চাষ করার জন্য। খবরে প্রকাশ: জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনি ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহমেদ রাসেল স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ফুলের টবে গাঁজা চাষ করছেন এমন অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্ত দুই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন শাখা ছাত্রলীগের উপ-ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক মো. রইছ (সাংবাদিকতা, ৪১ ব্যাচ) ও ছাত্রলীগ কর্মী মো. রাসেল (রসায়ন, ৪১ ব্যাচ)। উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক ছাত্র। তারা শহীদ রফিক জব্বার হলের ২০৯ ও ২১০ নম্বর রুমের জানালার পাশে ফুলের টবে গাঁজার চাষ করেন।

উইকিপিডিয়ায় গাঁজার পরিচিতি দিতে গিয়ে অন্যান্যের সাথে এটাকে বিনোদনমূলক ড্রাগ বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে গাঁজা খাওয়া বৈধও বটে। মনে পড়ে, আমি যখন ভলান্টারি হেলথ সার্ভিসেস সোসাইটি (ভিএইচএসএস)-এর কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করি তখন কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত সাংবাদিক মোঃ আরিফ। ১৯৯৬ সালে আমরা এক কাজ উপলক্ষ্যে বগুড়া গিয়েছিলাম। এক রাতে বগুড়া শহরের নিউমার্কেটের সিড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় আরিফ ভাই বললেন, “নবী এখানে কোথাও গাঁজা খাওয়া হচ্ছে। গন্ধ পাচ্ছো?” আমি বললাম, “না, পাচ্ছি না।” আরিফ ভাই বললেন, “কেন পাচ্ছো না? দাঁড়াও আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।” তখন বেশ রাত। শীতকাল। আমি খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না কেউ গাঁজা খাচ্ছে কিনা সেকথা জানতে। কিন্তু ভুলটা হলো যখন বললাম, “আরিফ ভাই আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে। আশেপাশে তো কাউকে দেখছি না।” এই কথাটাই আরিফ ভাইকে জেদী করে ফেলল। স্নেহ করুক আর যাই করুক, শত হলেও সুপারভাইজর। আমি তার সাথে গেলাম। বেশ কিছুটা দূরে এক চিপার মধ্যে একজন গাঁজাসেবীকে পাওয়া গেলো। এতো দূর থেকে আরিফ ভাই গন্ধ কীভাবে পেলেন সেকথা ভেবে আমি অবাক। ততোক্ষণে আরিফ ভাইয়ের গোঁফের নিচে সেই চিরচেনা মুচকি হাসি। বললেন, চলো আগে হোটেলে ফিরি তারপর বলব। হোটেল রুমে ফিরে আরিফ ভাইয়ের কাছ থেকে শুনলাম- কীভাবে তারা স্বাধীনতার পর ১৯৭২ কি ১৯৭৩ সালে (সালটা মনে করতে পারছি না) মতিঝিল এজিবি কলোনির মাঠে বাংলাদেশের প্রথম গাঁজা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে বিখ্যাত পপ তারকা আজম খানও আয়োজকদের একজন ছিলেন। মোঃ আরিফ ভাইয়ের ডাক নাম ছিল পুরন। এই লেখা যারা পড়বেন তাদের মধ্যে কেউ না কেউ হয়তো সেই সম্মেলনের কথা মনে করতে পারবেন। সেসময়ে বাংলাদেশে গাঁজা চাষ ও সেবন সবই আইনসিদ্ধ ছিল। তৎকালীন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা কিংবা অধ্যয়রণরত শিক্ষার্থীরা তখন বিড়ি সিগারেটের মতোই গাঁজাও সেবন করত।

১৯৮৯ সাল পর্যন্ত গাঁজা কিন্তু বাংলাদেশে কোন নিষিদ্ধ বস্তু ছিল না। বরং তামাক ও সিগারেটের মতোই গাঁজা রাজস্ব আয়ের একটি উপায় ছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে গাঁজার চাষ বন্ধ ও ১৯৮৯ সালে সকল গাঁজার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওয়েবসাইটে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইতিহাস অংশে লেখা রয়েছে যে, “১৯৮৯ সন পর্যন্ত নারকটিকস এন্ড লিকার পরিদপ্তরের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে উৎপাদিত মাদকদ্রব্য থেকে রাজস্ব আদায় করা। আশির দশকে সারা বিশ্বে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে এ সমস্যার মোকাবেলায় মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধ, মাদকের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গণসচেতনতার বিকাশ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৮৯ সনের শেষের দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ জারী করা হয়। অতঃপর ২ জানুয়ারী, ১৯৯০ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন,১৯৯০ প্রণয়ন করা হয় এবং নারকটিকস এন্ড লিকারের স্থলে একই বছর তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখ এ অধিদপ্তরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাস্ত করা হয়।”

গাঁজা খাওয়া সারা পৃথিবীতেই নিষিদ্ধ তবে বেশ কিছু দেশে চিকিৎসার প্রয়োজনে কোন কোন দেশে গাঁজা বৈধ। বৈধ দেশগুলোর মধ্যে উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, কানাডা, জার্মানিও রয়েছে। তারা চিকিৎসার প্রয়োজনে গাঁজা ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু যেহেতু আইন করে বাংলাদেশে গাঁজা চাষ ও সেবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেকারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সেটা মেনে চলা উচিত। নতুবা আইন পরিবর্তনের জন্য তাদের এডভোকেসি করা উচিত। মনে রাখা আবশ্যক যে, দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা যেকোন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।

লেখাটি চ্যানেলআই থেকে নেয়া 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)