জীবনের বিনিময়ে শিক্ষা!


মনজুরুল আহসান বুলবুল | Published: 2017-11-06 17:52:48 BdST | Updated: 2024-05-14 01:17:08 BdST

১. দীর্ঘ পেশাগত জীবনে শিক্ষা নিয়ে কতই না আলোচনা শুনলাম। ‘সবার জন্য শিক্ষা’, ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা’, ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’— এরকম আরও কত কী।

আমাদের ছাত্রকালের ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার’— এ স্লোগানে আজও মাঠ কাঁপায় তরুণরা। শিক্ষার জন্য জীবন দেওয়ার অঙ্গীকার তো এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেই গ্রন্থিত। ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ ধরেই তো পরবর্তীকালের ছাত্রদের ১১ দফা। শিক্ষা নিয়ে এসব আন্দোলন এবং আন্দোলনে জীবন দেওয়াও গৌরবের, অহংকারের।
কিন্তু শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নদী পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যু!! শিক্ষার জন্য এই করুণভাবে জীবন দেওয়ার ব্যাখ্যা কী? খবরটি পড়তে গিয়ে যে কারও চোখ ভিজে উঠবে : গত ১ নভেম্বর, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর কৃষ্ণনগর আবদুল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল ভেজা কাপড়ে পরীক্ষা দিতে বসেছে কয়েক শিক্ষার্থী। তাদের হাতে কলম, সামনে পরীক্ষার খাতা খোলা কিন্তু তারা কিছুই লিখতে পারছে না। কারণ একটু আগে, এই পরীক্ষা দিতে আসার পথে পাগলা নদীতে নৌকাডুবিতে তারা তাদের দুই সহযাত্রীর মৃত্যু দেখে এসেছে। কোনো মতে স্থানীয় উদ্ধারকারীরা তাদের উদ্ধার করে পাঠিয়েছে পরীক্ষার হলে। দুই বন্ধু মারা গেছে, নিজেরা মরতে মরতে বেঁচে গেছে, কিন্তু পরীক্ষা তো বাদ দেওয়া যাবে না! জীবন দিয়ে হলেও শিক্ষা তো অর্জন করতেই হবে!! সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের হাত থেকে পরীক্ষার হলে—এ বুঝি এ দেশেই সম্ভব।

সাংবাদিক বলছেন : বীরগাঁও স্কুলের শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পাগলা নদ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় কৃষ্ণনগরে। বীরগাঁও স্কুলটি যেখানে অবস্থিত সেই থানাকান্দি থেকে কৃষ্ণনগরের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার; কিন্তু সেখানে যেতে নৌপথই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বীরগাঁও স্কুলের শিক্ষার্থীদের সিট পড়েছে কৃষ্ণনগরে। ঝুঁকি নিয়ে নৌপথ পাড়ি দিয়ে ২৮৪ জন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে যেতে হয় সেখানেই। প্রথম দিনের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনা, দুই শিক্ষার্থীর অসহায় মৃত্যু। ঘটনা ঘটার পর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন : আগামীতে যেন কোনো শিক্ষার্থীকে ঝুঁকি নিয়ে কেন্দ্রে যেতে না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে শিগগিরই চিঠি লেখা হবে। খুব সহজেই যেন যাওয়া যায় এমন কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ বিষয়টি বুঝতে শিক্ষা কর্মকর্তার দুজন কিশোরীর জীবনের প্রয়োজন হলো?

মাস কয়েক আগে এ রকম একটা ছবি দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। সুরমার বুকে ছোট্ট একটা নৌকা, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী— সবাই দাঁড়িয়ে-বসার কোনো সুযোগ নেই, মাঝি একজন। ওরা কোনো সাধারণ যাত্রী নয়। প্রায় সবার পরনেই ইউনিফর্ম বলে দেয় সবাই যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই শিক্ষার্থীদের প্রায় প্রতিদিন সাচনাবাজার থেকে জামালগঞ্জে যেতে হয়, ফিরতে হয় একইভাবে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে। আর কোনো বিকল্প নেই, শুকনো মৌসুমে পানি হয়তো কমে কিন্তু তাতে হাঁটার সড়ক জাগে না, চলতে হয় নৌকায় করেই। জামালগঞ্জ-সাচনাবাজার সুরমা নদীর ওপর মাত্র ৩০০ মিটার দৈর্ঘের একটি সেতুর অনুপস্থিতি দুই পারের মানুষের সহজ জীবনকে আটকে দিয়েছে। জামালগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রছাত্রী মৃত্যুকে হাতে নিয়ে প্রতিদিন নৌকায় গিয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন এই পথের যাত্রী কলেজ ছাত্রী শামীমা সুলতানা, রাহিমা বেগম, জান্নাতুননেছা বলেন : আমরা তো জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পারাপার হই, খেয়ার এমন অবস্থা হয় মনে হয় এই বুঝি ডুবল। দেখেন না কী অবস্থা!!

২.

মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। কৃষির ঊর্ধ্বতনরা বলেন : কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড, শিল্পের ঊর্ধ্বতনরা বলেন : এ যুগে শিল্পই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষার ঊর্ধ্বতনরা বলেন : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। বেশ কিছুকাল আগে এক ব্যবসায়ী নেতা তো বলেই বসলেন : এতকাল শুনেছি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে বলতে চাই অর্থই জাতির মেরুদণ্ড! শোনার পর হতভম্ব হয়ে থাকি। বাংলাদেশ উচ্চকণ্ঠ মানুষের দেশ। যে যত চেঁচিয়ে কথা বলতে পারে তাদেরই রাজত্ব এই দেশে। তবে এটুকু বুঝি; কোনো মেরুদণ্ডী প্রাণী যদি সোজা হয়ে দাঁড়াতে চায় তাহলে তার একটি দৃঢ় মেরুদণ্ড থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশটিকে আমরা শক্ত ভিতের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো দেখতে চাই। সেজন্য দৃঢ় মেরুদণ্ডের কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতার চার দশক যদি মেরুদণ্ড খুঁজতেই চলে যায় তাহলে সেই মেরুদণ্ড নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে কতদিন লাগবে কে বলতে পারে।

এই দৃঢ় মেরুদণ্ডের উৎস সন্ধানেই বছর কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলাম। লাখ লাখ জিপিএ-৫ এর ভিড়ে যখন সবাই বিভোর তখন একটি শিক্ষাবিষয়ক সংগঠন সিদ্ধান্ত নিল, এই এত জিপিএর ভিড়ে যে শিক্ষার্থীরা ফেল করছে তারা কেন ফেল করছে তা জানার জন্য। ফেল করা কিছু শিক্ষার্থী, তাদের স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক আর বিদ্যালয় কমিটির কর্তাব্যক্তিদের ডাকা হলো। তারা বর্ণনা করলেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। ইংরেজি, অঙ্ক আর বিজ্ঞান বিভাগের ভালো শিক্ষক নেই এটি তো সাধারণ অভিযোগ। হাওর অঞ্চলের এক শিক্ষার্থী জানাল— বছরের ছয় মাস তো স্কুলেই যেতে পারে না, কারণ তার বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূর, নৌকাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সংসারের একমাত্র নৌকাটি বাবা-ভাইয়ের দখলে থাকে মাছ ধরে বিক্রি করার জন্য। সেই মাছ বিক্রির টাকা দিয়েই তো সংসার চলে? মাছ ধরার চেয়ে মেয়ের শিক্ষা তো আর গুরুত্বপূর্ণ নয়! উত্তরবঙ্গের এক অভিভাবক বললেন : পথে বখাটেদের উপদ্রবের জন্য মেয়েটিকে তিনি স্কুলে নিয়ে যেতে পারেন কেবল সপ্তাহে দুই হাটবারের দিনে। অন্য সমস্যার কথা যদি বাদও দিই, যে মেয়েটি ছয় মাস স্কুলে যেতে পারে না, যে মেয়েটি সপ্তাহে দুই দিনের বেশি স্কুলে যেতে পারে না সেই মেয়ে পরীক্ষায় পাস করে কী করে? অনুষ্ঠানের উপসংহারটি হলো : বছরের প্রথম দিনে বই, ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি, শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনতে পরিবারকে খাদ্য জোগান সব খুবই ভালো উদ্যোগ কিন্তু কেবল এসবই ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিত করে না। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য করণীয় আছে আরও অনেক কিছু।

বীরগাঁও স্কুলের নাদিয়া-সোনিয়াকে শুধু শিক্ষার জন্য জীবন দিতে হবে? জামালগঞ্জের শত শত শিক্ষার্থীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হবে খরস্রোতা নদী? সেতু কবে হবে, সড়কপথ কবে সে বিতর্কে না গিয়ে বলি : শিক্ষার জন্য জীবন দেওয়ার যে ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে তার দায় কাউকে না কাউকে তো নিতে হবে? কেন তারা খুব সহজেই যাওয়া যায় এমন কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারবে না? কেন তারা সহজে যাওয়া যায় এমন স্কুলে গিয়ে পড়তে পারবে না?

৩.

চট্টগ্রামের স্বনামখ্যাত বাম তাত্ত্বিক আসহাব উদ্দিন রসিকতা করে এক নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছিলেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে। তার মন্তব্য : ‘আমাদের কালে স্কুলঘরগুলো ছিল নড়বড়ে, কিন্তু শিক্ষাটা ছিল শক্ত; এখন স্কুলঘরগুলো হয়েছে পোক্ত কিন্তু নড়বড়ে হয়ে গেছে শিক্ষা। ’ যারা ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বা ‘শিক্ষার গুণগতমান’ নিয়ে সরব তারা প্রয়াত আসহাব উদ্দিনের রসিকতার মর্মার্থ থেকে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারেন।

শুধু বলি : শিক্ষা ও জীবন দুটোর মধ্যে বেছে নিতে হলে জীবনকেই বেছে নিতে হবে; কারণ জীবনই যদি না থাকে তাহলে শিক্ষার প্রয়োজন কী? কিন্তু আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের শিক্ষার জন্য যতটা ভাবছি তাদের জীবন নিয়ে ততটা নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাগলা নদে ডুবে মারা যাওয়া নাদিয়া আর সোনিয়ার জীবনের দাম কুড়ি হাজার টাকা!!! জীবন এত সস্তা এদেশে! বলি : জীবন মূল্যবান শুধু নয় অফুরন্ত সম্ভাবনাময়ও, তা সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাদিয়া-সোনিয়ার জীবনই হোক বা জামালগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনই হোক। তাদের সেই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, শুধু শিক্ষার জন্য দেওয়া জীবনকে আর্থিক মূল্য দিয়ে কেনার এ উদ্যোগ জীবনকেই অপমানিত করে।

সতর্ক করি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : “হে মোর দুর্ভাগা দেশ/যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে/তাহাদের সবার সমান। ”

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।

কেএস/ ০৬ নভেম্বর ২০১৭